বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্যেশ্যে দেয়া ভাষনের পর রাজনীতি এখন এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বামে গেলেও সন্দেহ আবার ডানে গেলেও সংকট। বহুদিন ধরে এদেশের রাজনীতির মাঠে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীর ৮ দলীয় অভিন্ন সমঝোতা এবং এনসিপির প্রত্যক্ষ ভূমিকায় বহুল আলোচিত জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দ্বিধা–দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে সরকার ঘোষণা দিয়েছে—জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে একই দিনে। রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে কার্যকর হবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ। সরকার বলছে, এটি স্থিতিশীলতার পদক্ষেপ, কিন্তু সরকার পক্ষ কিংবা সরকার বিরোধীদের অনেকেই বলছে—এটি নতুন এক রাজনৈতিক গিট্টু। এখন প্রশ্ন উঠেছে, সরকার সত্যিই দীর্ঘদিনের প্যাচ লাগানো জট খুলল, নাকি কৌশলে রাজনীতির মাঠে আরও নতুন এক জটিল গিট্টু বেঁধে ফেলল?
বিএনপি এই সিদ্ধান্তে একই সঙ্গে হাসতেও পারছে না, কাঁদতেও পারছে না। কারণ বিএনপি আজকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজনীতির খেলায় অনেকাংশেই লাভবান এবং অনেকাংশে বেকায়দায় পরে গেছে। একদিকে তাদের দীর্ঘদিনের দাবি—রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে জুলাই সনদ কার্যকর করা এবং গণভোট ও নির্বাচন একই দিনে করার প্রস্তাব। সরকার দুইটি দাবিই তাদের পক্ষে গ্রহণ করেছে। বাহিরে থেকে দেখলে এটি বিএনপির বড় সাফল্য। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে চিন্তা করে এর সুদুরপ্রসারি ফলাফল কি হতে পারে একথা ভাবতে গেলে এই সাফল্যের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজনৈতিক কৌশলের ফাঁদ।
বিএনপি মূলত গণভোটের পক্ষেই ছিল না। তাদের অবস্থান ছিল আগে জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, পরে গণভোট। এখন নির্বাচনের দিনেই গণভোট মানে তাদের নীতিগত অবস্থানের মৌন পরিবর্তন। এটি অনেকটা দাবার বোর্ডে রাজাকে বাঁচাতে নিজের মন্ত্রীকে উৎসর্গ করার মতো। রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা বজায় রাখতে গিয়ে তারা নীতির ধারায় আপাতত তাদের শক্তিশালী দলগত নিজস্ব অবস্থান অনেকটা হারিয়েছে।
জুলাই সনদের যেসব ধারায় বিএনপি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছিল, বিশেষ করে উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতি, সেগুলোই এখন গণভোটের হ্যা-না প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। যদি ‘হ্যাঁ’ ভোট সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়, তাহলে বিএনপিকে নিজস্ব পূর্বঘোষিত অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে, যা তাদের জন্য রাজনৈতিক ও নৈতিক উভয় সংকট তৈরি করবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয় মানেই সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করতেই হবে, যার নেতৃত্ব দেবে নির্বাচিত সংসদ। যেহেতু আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানা কৌশলগত ইস্যু, রাজনৈতিক সমীকরণ, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ প্রত্যক্ষভাবে ফলাফলে ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে সেহেতু সেই সংসদ যদি জামায়াতে ইসলামী, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও এনসিপির সাথে বিএনপি বিরোধী বিরাট অংশ মিলে নিয়ন্ত্রণ করে, তবে বিএনপির হাতে রাজনৈতিক প্রভাবে বিস্তারের সুযোগ থাকবে সীমিত। এক কথায়, তারা অংশ নিলেও খেলায় সুবিধা পাবে না, যেমন ফুটবল খেলায় গোল করার সুযোগ থাকলেও বল অনেক সময় অন্য কারও নিয়ন্ত্রণে থাকায় গোল হয় না।
তবে বিএনপির জন্য এক ধরনের বড় রাজনৈতিক লাভও রয়েছে। সরকার আলোচনায় তাদের মূল দাবির দুইটাই মানায়। তারা এখন এই সরকারের কাছের দল এবং তাদের এই সরকারের নিকট গ্রহনযোগ্যতা যে প্রান্তিক নয় এ ধারণা জনগণের মধ্যে এবং বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে জোরদার হচ্ছে। এটি বিএনপিকে নতুন করে আলোচনার রাজনীতির পথে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে তারা বলতে পারবে—“আমরা সংঘাত নয়, সংলাপ চাই।”
তরুণ ও মধ্যবিত্ত ভোটারদের কাছে এটি ইতিবাচক বার্তা হতে পারে। তবে এই লাভ শেষ পর্যন্ত টিকবে কি না, তা নির্ভর করছে গণভোটের ফলের ওপর। কারণ, ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে বিএনপি নীতিগতভাবে পরাজিত হবে, আর ‘না’ জয়ী হলে বিএনপি সরকার গঠন এর সুযোগ পেলেও রাজনৈতিকভাবে মহা সংকটে পড়বে। সেক্ষেত্রে জুলাই সনদের বাস্তবায়নের পক্ষে উদ্যোগ নেয়া রাজনৈতিক দল ও কক্ষগুলোর ভূমিকা কি হয় তা বোঝা কঠিন। বিএনপি যেন নদীর গভীরে উভয় সংকটে, দুই পারে আগুন, মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিএনপি খুঁজছে ফেরির দড়ি।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সাথে এই মুহূর্তে একতাবদ্ধ আন্দোলনের শরীক দলগুলো এই সিদ্ধান্তে কার্যত রাজনৈতিকভাবে একঘরে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। তাদের মূল অবস্থান ছিল—গণভোট আগে, নির্বাচন পরে এবং জুলাই সনদে স্বাক্ষর দেবেন প্রধান উপদেষ্টা। সরকারের ঘোষণায় তিনটির একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান এখন অনেকটা বালির ওপর দাঁড়ানো ঘরের মতো “ভিতরে শক্তি নেই, বাইরে ঝড় বইছে।” তাদের সামনে এখন দুটি পথ—গণভোট বর্জন বা ‘না’ প্রচারণা তবে দুটোই ঝুঁকিপূর্ণ। বর্জন করলে তারা মূলধারার বাইরে চলে যাবে আর অংশ নিলে ফলাফল মেনে নিতে হবে। এ যেন এমন এক খেলায় অংশ নেওয়া, যেখানে হারলেও বিপদ, জিতলেও বিপদ।
এদিকে এনসিপি বরাবরই ছিল সমঝোতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তারা গণভোটের পক্ষে ছিল, তবে সময় নিয়ে ছিল নমনীয়। ফলে তাদের অবস্থান এখন মুখরক্ষার সুযোগ পেয়েছে। সরকার যখন জামায়াতের অবস্থান উপেক্ষা করেছে, তখন এনসিপির প্রস্তাবের প্রতিফলন আংশিকভাবে ঘটেছে। এতে দলটি ‘দায়িত্বশীল সমঝোতাকারী শক্তি’ হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে পারছে। অপরদিকে নতুন প্রজন্মের দল “আপ বাংলাদেশ” যেন কাকতালীয়ভাবেই কিছুটা নিঃশব্দ বিজয় পেয়েছে। কারণ গণভোট, দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমা এসবই তাদের প্রস্তাবনাগুলোর অংশ ছিল। তাদের সাথে আজকের সিদ্ধান্তগুলো মিলে যাওয়ায় তারা এখন মূলধারার রাজনীতিতে একটি নতুন সম্ভাবনা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।
রাজনৈতিকভাবে এইমুহূর্তে সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থানে থাকা আওয়ামী লীগ এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সবচেয়ে স্বস্তিতে আছে। তারা মনে করছে, গণভোট ও নির্বাচন একসাথে হলে ভোটের উপস্থিতি বাড়বে, রাজনৈতিক প্রচারণা তীব্র হবে আর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণও সরকারের হাতেই থাকবে। তারা একে “জনগণের সরাসরি মতামতের উৎসব” হিসেবে তাদের ভোট ব্যাংকের নিকট প্রচার করবে এবং জুলাই সনদের বিপক্ষে ভোট দেয়ার জন্য উৎসাহিত করবে যা আন্তর্জাতিক মহলে আওয়ামী লীগের জন্য কিছুটক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আনতে পারে। জাতীয় পার্টি বরাবরের মতো ভারসাম্যের রাজনীতি করছে। প্রকাশ্যে বলছে, গণভোট জনগণের কণ্ঠের নতুন জানালা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা দেখছে কোন দিকের বাতাস জোরে বয়। সেদিকেই জাতীয় পার্টি অবস্থান নেবার জোর সম্ভাবনা। তাদের অবস্থান অনেকটা সেই নৌকার মতো, যেদিকের বাতাস প্রবল, সেদিকেই পাল ঘোরায়।
প্রধান উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক মহলেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, “সরকারের এই উদ্যোগ সফল হবে কেবল তখনই, যদি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব পক্ষের মতামত গ্রহণ হয় এবং সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।” ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদিও এই সিদ্ধান্তকে দেশের চলমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ‘অন্তর্ভূক্তিমূলক পদক্ষেপ’ বলে স্বাগত জানিয়েছে। তবে স্বচ্ছতা, অংশগ্রহনমুলক ও সহিংসতাহীন নির্বাচনের ওপর জোর দিয়েছে। অবশ্য প্রতিবেশি দেশ ভারত ও চীন বরাবরের মতোই স্থিতিশীলতার পক্ষে, তাদের কাছে গণভোট মানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ধারাবাহিকতা। এভাবে বাংলাদেশ এখন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের এক অজানা পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে, যেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, গণতন্ত্র, কূটনীতি ও স্থিতিশীলতার প্রশ্ন একসাথে মিশে গেছে।
গণভোটের কাঠামোও অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। চারটি প্রশ্ন থাকবে, কিন্তু ভোট দিতে হবে একটিই ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’। অর্থাৎ জনগণকে চার পদ খাবার দেওয়া হলেও খেতে হবে একসাথে বা একদমই নয়। এতে ভোটারদের নির্দিষ্ট বিষয়ে মতামত জানানোর সুযোগ কমে যাচ্ছে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এটি এক প্রকার সর্বসম্মত রায় হয়ে উঠবে। ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে, দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ বাস্তবায়ন হবে এবং প্রধানমন্ত্রী মেয়াদ সীমা কার্যকর হবে। কিন্তু ‘না’ জয়ী হলে পুরো প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আরও গভীর হবে। জুলাই অভ্যুত্থান সময়কালীন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক আন্দোলন এর ঐক্য এবং পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক অসহিষ্ণু পরিবেশ পরিস্থিতিতে এই “না” এর প্রভাব কতটা প্রভাব বিস্তার করে তা ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সবশেষে বলা যায়, সরকার আপাতদৃষ্টিতে চলমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক প্যাচের জট খুলেছে, কিন্তু বাস্তবে হয়তো এই জট খুলতে গিয়ে আবার নতুন জটিল গিট্টু বেঁধেছে। বিএনপি হয়তো আপাতদৃষ্টিতে পেয়েছে অনেক বেশি কৌশলগত সুবিধা, কিন্তু হারিয়েছে নীতিগত ধারাবাহিকতা। জামায়াত হারিয়েছে মনোবল ও সরকারের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতা, এনসিপি পেয়েছে মুখরক্ষার সুযোগ, আর আপ বাংলাদেশ পেয়েছে স্বস্তির সম্ভাবনা। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতি আজ অনেকটা নদীর স্রোতের মতো যা কখনও সোজা চলে না—কখনও ঘুরে যায় সামনে, কখনো পেছনে, কখনও বয়ে যায় বৃত্তে।
এখন সবকিছু নির্ভর করছে জনগণের ওপর। তারা ‘হ্যাঁ’ বলবে, নাকি ‘না’ বলবে। জনগণের একই দিনে একসাথে একসময়ে নিজস্ব পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে এবং গনভোটে রায় দিতে হবে। জনগণের দেয়া সেই রায়ই নির্ধারণ করবে গিট্টু সত্যিই ছুটল কিনা, নাকি শুধু জায়গা বদল করে আরও জটিল গিট্টু সৃষ্টি হলো।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ, ডীন ও চেয়ারম্যান, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
কেকে/ আরআই