দেশের রাজনীতিতে আবারো ফিরে এসেছে আগুন সন্ত্রাসের বিভীষিকা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ককটেল বিস্ফোরণ ও হামলার ঘটনা জনমনে গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে।
ময়মনসিংহে বাসে আগুনে পুড়ে এক চালকের মৃত্যু, ঢাকার সূত্রাপুরে মালঞ্চ বাসে আগুন, মিরপুরের সনি সিনেমা হলের সামনে শতাব্দী পরিবহনের বাসে আগুন দেওয়াসহ সারা দেশে ১৩টিরও বেশি বাসে আগুন দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। এই সন্ত্রাসের শেষ কোথায়? কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ১৩ নভেম্বরের লকডাউনকে ঘিরে নানা গুজব, অনলাইন উসকানি ও বিচ্ছিন্ন সহিংস ঘটনার ধারাবাহিকতায় মানুষের মনে জাগ্রত হয়েছে ২০১৪ সালের সহিংস নির্বাচনি সময়ের স্মৃতি। তিন মাসের সেই ভয়াল সময়ের মতোই আবার যেন ফিরে আসছে পেট্রোলবোমা, ভীত-সন্ত্রস্ত নাগরিক জীবন, আর রাজনীতির নামে নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি। ওই তিন মাসেই পেট্রোলবোমা ও অগ্নিসংযোগে দগ্ধ হয়ে মারা যান ১৫৩ জন সাধারণ মানুষ। আহত হন দুই হাজারেরও বেশি, যাদের অনেকেরই চোখ নষ্ট হয়ে গেছে, কারো হাত, কারো পা কেটে ফেলতে হয়েছে।
সরকার বলছে, কোনোভাবেই আগুন সন্ত্রাসের রাজনীতি সহ্য করা হবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। তবে নিরাপত্তার নানা আশ্বাস সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। বাসে উঠতে ভয় পাচ্ছে কর্মজীবী মানুষ, উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছে ব্যবসায়ী থেকে অভিভাবক- সবাই। গতকাল রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিনকার মতো ব্যস্ততা চোখে পড়েনি। রাস্তাঘাটে যান চলাচল ছিল অন্যান্য দিনের থেকে কম। কেউ কেউ বলছেন- এসব ঘটনা কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটির। তাদের ১৩ তারিখের লকডাউনকে ঘিরে নানারকম সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করছে সে বিষয়টি স্পষ্ট।
জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে লকডাউনকে সফল করতে চাইছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলটি। অতীতেও আমরা দেখেছি- রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের চর্চার ফল ভয়াবহ। ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পুরোনো কৌশল। নতুন বাংলাদেশে সবাই স্বপ্ন দেখেছিল এই বাংলাদেশে আর দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি আর চলবে না। কিন্তু অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশের রাজনীতি আরো সহিংস হয়ে উঠেছে। বেড়েছে রাজনৈতিক দোষারোপের পুরানো প্রবণতা, যা বরাবরের মতোই পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করে তুলছে। একে অপরকে দায়ী করার চেয়ে এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে- জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়- এমন কোনো ঘটনা না ঘটতে দেওয়া।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, এই সহিংসতার মূল লক্ষ্য হলো ভয় সৃষ্টি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ানো। আর সেই ভয়কে পুঁজি করেই দুর্বৃত্তরা দেশজুড়ে বিশৃঙ্খলা ছড়াতে চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু কঠোরতা প্রদর্শন নয় বরং এটি হতে হবে সুনির্দিষ্ট ও দায়বদ্ধ আইনি পদক্ষেপের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। দোষীদের রাজনৈতিক পরিচয় নয়, অপরাধের ভিত্তিতে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
সময় এসেছে রাজনৈতিক দলগুলোকেও বিরোধ ভুলে দায়িত্বশীল হওয়ার। জনজীবনকে জিম্মি করে কোনো আন্দোলন বা প্রতিশোধের রাজনীতি চলতে পারে না। আগুনে শুধু গাড়ি নয়- পুড়ছে মানুষের জীবন, জীবিকা ও ভবিষ্যৎ। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক সহিংসতা কখনো কোনো সমাধান নয়। গণতন্ত্রের শক্তি সহিংসতায় নয়- সংলাপ, সমঝোতা ও সহনশীলতায়। শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে, জনজীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে-রাজনীতিকে অবশ্যই মানবিকতার চর্চায় ফিরিয়ে আনতে সকলের নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেষ্ট হতে হবে।
কেকে/এআর