বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫,
১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বিশৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ দেয়া হবে না : ধর্ম উপদেষ্টা      ডেঙ্গুতে মৃত্যু আরও সাত, হাসপাতালে ভর্তি ৫৬৭      ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফের ভূমিকম্প      দুদকের সব কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক সম্পত্তির হিসাব দিতে হবে      প্রাথমিক শিক্ষকদের লাগাতার কর্মবিরতি      নির্বাচনী জোটের আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে : রাশেদ খান      গণতন্ত্র ফেরাতে নির্বাচনের বিকল্প নেই : আমান      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
রাজনীতির চক্রব্যূহে বন্দি গণতন্ত্র
বিমলেন্দু রায়
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫, ১০:৪৭ এএম
ছবি : খোলা কাগজ

ছবি : খোলা কাগজ

চক্রব্যূহ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত চক্রব্যূহ থেকে। যার অর্থ হলো- জটিল ঘের বা ফাঁদ। মহাভারতের ভাষায় এটি ছিল এমন এক সামরিক ঘের যেখান থেকে বের হওয়া কঠিন। রাজনৈতিক অর্থে রাজনীতির চক্রব্যূহ মানে হচ্ছে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, দলীয় স্বার্থ, ক্ষমতার দখল, অর্থবল ও প্রভাববল দ্বারা তৈরি এক জটিল কাঠামো, যেখানে সাধারণ মানুষ ও গণতন্ত্র বন্দি হয়ে পড়ে। গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হলো- জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ন্যায় বিচার ও সমঅধিকার রক্ষা করা। সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক রাখা। কিন্তু যখন রাজনীতি স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে যায় তখন এই উদ্দেশ্যগুলো ব্যাহত হয়। তখন রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান দলীয় প্রভাবের অধীনে চলে যায়। ভোটাধিকার কাযর্ত ও সীমিত হয়ে যায়। 

জনস্বার্থের পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ অগ্রাধিকার পায়। ভিন্নমত বা সমালোচনা সহ্য করা হয় না। সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়। এভাবে গণতন্ত্র কাগজে-কলমে টিকে থাকলেও বাস্তবে তা ছদ্ম গণতন্ত্র বা নাটকীয় গণতন্ত্রে পরিণত হয়। জনগণ তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। আর শাসন ব্যবস্থা হয় একদলীয় বা একনায়কতান্ত্রিক চরিত্রের। গণতন্ত্রকে রাজনীতির এ চক্রব্যূহ থেকে মুক্ত করতে প্রয়োজন স্বচ্ছ নির্বাচন ব্যবস্থা, স্বাধীন বিচার বিভাগ, শক্তিশালী ও স্বাধীন গণমাধ্যম, সচেতন নাগরিক সমাজ এবং দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রধিকার দেওয়া নেতৃত্ব। রাজনীতির চক্রব্যূহে বন্দি গণতন্ত্র অনেক সময় রুগ্ন শরীরে দিন যাপন করে। সুন্দর ও সুষ্ঠু পরিবেশের অভাবে তার বিকাশমান ঘটে না। যা দেশের জন্য, জনগণের জন্য দুর্ভাগ্যজনক। 

তখন অঝোরে কাঁদে গণতন্ত্রের মানসপুত্র, আজন্ম পূজারী যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট যিনি ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। খুব অল্প শিক্ষিত (আনুষ্ঠানিক শিক্ষা) হলেও তিনি স্বশিক্ষিত ও জ্ঞানী ছিলেন। তার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রে দাস প্রথা বিলুপ্ত হয়। তিনি গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক ছিলেন। তার বিখ্যাত উক্তি Government of the people, by the people, for the people, shall not perish from the earth. যুক্তরাষ্ট্রে civilwar (গৃহযুদ্ধ) শেষ হওয়ার কিছুদিন পর ১৪ এপ্রিল ১৮৬৫ সালে উইল্কস বুথ নামের এক দক্ষিণপন্থি অভিনেতা তাকে গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ১৫ এপ্রিল ১৮৬৫ সালে তার মৃত্যু হয়। লিংকনকে আমেরিকার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্টদের একজন হিসেবে গণ্য করা হয়। গণতন্ত্র কালে কালে দেশে দেশে অনেক জটিল ও কুটিল আবহাওয়ায় পরিচালিত হয়।

রাজনীতিতে রাজনীতির চক্রব্যূহ এমন একটি গোলক ধাঁধা, ক্ষমতার গোলক ধাঁধা যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ হিসেব করে ফেলতে হয়। কারণ ভুল সিদ্ধান্ত মানে  পতন। রাজনীতির স্তরভিত্তিক জটিলতা আছে। রাজনীতি কেবল ভোট, দল বা সরকার নয়, এটি একটি বহুমাত্রিক খেলা। প্রথমে রাজনীতি শুরু হয় কোন আদর্শ বা নীতির নামে। সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন, ন্যয় বিচার, সমতা ইত্যাদি বিষয়ে। কিন্তু বাস্তবে ক্ষমতার খেলায় প্রবেশ করলে এই আদর্শগুলো অনেক সময় কৌশলের কাছে নতি স্বীকার করে। প্রত্যেক রাজনীতিবিদ, দল, এমনকি সাধারণ কর্মীও কোনো না কোনো স্বার্থ দ্বারা চালিত হয়। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত এই স্বার্থের সংঘর্ষই চক্রব্যূহকে জটিল করে তোলে। রাজনীতির প্রকৃত খেলা চলে এই স্তরে। এখানে মিত্রতা গড়ে ওঠে, আবার ভেঙেও যায়। 

বন্ধুত্ব হয় কৌশলের কারণে, শত্রুতাও প্রায় রাজনৈতিক নাটকের অংশ হিসেবে দেখা যায়। জনগণকে প্রভাবিত করা, তাদের অনুভূতি, জাতীয়তাবোধ, ধর্ম, ভাষা বা সংস্কৃতিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা এই চক্রব্যূহের অংশ হিসেবে কাজ করে। রাজনীতিতে কুটিলতা মানে সরল পথ নয়, বরং অপ্রত্যাসিত চাল। প্রকাশ্যে এক কথা, অন্তরে আরেকটা পরিকল্পনা। শত্রুকে বন্ধু সাজিয়ে রাখা। অথবা বন্ধুকে বানানো। জনতার আবেগকে নিজের অস্ত্রে পরিণত করা। পরাজয়কেও ভবিষ্যতের জয়ের জন্য কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা। এই কুটিলতার জালেই রাজনীতির প্রকৃত রূপ ফুটে ওঠে যেখানে নীতি ও বাস্তবতা প্রায়ই পরস্পরবিরোধী। চানক্যের রাজনীতিতে নন্দ বংশ পতনের পেছনে কৌশল, ধৈর্য ও প্রতারণার এক অপূর্ব মিশ্রণ ছিল। যা ছিল মহাত্মা গান্ধী ও নেতাজির ক্ষেত্রেও উভয়ের লক্ষ্য স্বাধীনতার হলেও পথ ছিল ভিন্ন। 

একটি আদর্শ বনাম বাস্তব রাজনীতির সংঘাত। আধুনিক রাজনীতিতে ভোটের সময় জনমোহিনী প্রতিশ্রুতি, জোট রাজনীতি, মিডিয়া ম্যানিপুলেশন সবই চক্রব্যূহের আধুনিক রূপ। রাজনীতির চক্রব্যূহ থেকে মুক্তি মেলা কঠিন। কারণ রাজনীতি মানুষের ক্ষমতা লিপ্সার স্বাভাবিক ফল। আর ক্ষমতা সব সময়ই সংঘর্ষ সৃষ্টি করে। তবে সুশাসন ও নৈতিকতার মাধ্যমে এক চক্রব্যূহকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব, তবে পুরোপুরি ভাঙ্গা নয়।

রাজনীতির চক্রব্যূহ এক অবিরাম খেলা, যেখানে প্রবেশ সহজ, কিন্তু নিষ্কলুষ থাকা কঠিন। এটি মানব সভ্যতার এক প্রাচীন বাস্তবতা। রাজনীতিতে কোনো চিরশত্রু নেই আবার কোনো চির বন্ধুও নেই, আছে কেবল চিরস্থায়ী স্বার্থ। তাহলে রাজনীতি আমরা কেন করি, কিজন্য করি এর উত্তর একমাত্রিক নয়। কারণ রাজনীতি মানুষের সমাজবোধ, ক্ষমতা লিপ্সা, ন্যায় বোধ এবং স্বার্থ সবকিছুর মিলিত ফল। রাজনীতির মূল লক্ষ্য হলো- ক্ষমতা অর্জন ও তা প্রয়োগ করা। ক্ষমতা মানেই শুধু শাসন নয়। ক্ষমতা মানেই নিয়ন্ত্রণ, প্রভাব এবং নির্দেশনা। মানুষ রাজনীতি করে কারণ সমাজে প্রভাব বিস্তার করা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করা, নিজের মতামত বা চিন্তা প্রতিষ্ঠা করাই এর মুখ্যতম কারণ। 

সংক্ষেপে রাজনীতি হচ্ছে সমাজের নিয়ন্ত্রণের খেলা। সব রাজনীতি কেবল স্বার্থ নির্ভর নয়। অনেক মানুষ রাজনীতিতে আসে সমাজ পরিবর্তনের আশায়। অন্যায় ও বৈষম্য দূর করা, শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনীতি বা আইনের সংস্কার করা, দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তবে অনেক ক্ষেত্রে এ আদর্শ পরে বিকৃত হয়ে যায়। শুরুটা নীতি দিয়ে হলেও শেষটা স্বার্থ দিয়ে শেষ হয়। রাজনীতি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ক্ষেত্র। রাজনীতির মাধ্যমে সম্পদ, ব্যবসা, সুযোগ ও প্রভাব অর্জন করা যায়। ক্ষমতার সংগে থাকে আর্থিক সুবিধা। টেন্ডার, প্রকল্প, কমিশন ও প্রভাব।

তাই অনেকে রাজনীতিকে অর্থ উপার্জনের বিকল্প পথ হিসেবেও এটাকে দেখে। পদ পাওয়া মানে মর্যাদা। জনগণকে প্রভাবিত করা মানে সামাজিক শক্তি অর্জন। এই সামাজিক স্বীকৃতির আকাক্সক্ষা অনেকেই রাজনীতির দিকে টেনে নিয়ে যায়। কেউ কেউ রাজনীতি করে নিজের অস্তিত্বের চিহ্ন রেখে যেতে। তারা মনে করে আমি মারা  গেলেও আমার কাজ, আমার নীতি ইতিহাসে টিকে থাকবে। তাছাড়া মানুষ একা থাকতে চায় না। তাই গোষ্ঠীতে নিরাপত্তা খোঁজে। রাজনীতি সেই গোষ্ঠী যে চেতনাকে উজ্জীবিত করে। গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, ''Man is by nature a political animal' অর্থাৎ মানুষ স্বাভাবত রাজনৈতিক প্রাণী। কারণ যেখানে সমাজ আছে, সেখানেই থাকবে সিদ্ধান্ত, নেতৃত্ব এবং বিরোধ, যা রাজনীতির মূল বিষয়। রাজনীতি মানুষ করে নিজের প্রভাব বিস্তারের জন্য। কিন্তু সেই প্রভাব ব্যবহার করা হয়, কারো জন্য আদর্শে, কারো জন্যে স্বার্থে। এটাই রাজনীতির চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সাবেক উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

কেকে/এআর
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বিশৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ দেয়া হবে না : ধর্ম উপদেষ্টা
গাজীপুরে রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী
টস জিতে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও অবকাঠামো সংকট, চরমে দুর্ভোগে বিয়ানীবাজারবাসী
আবুল সরকারকে মুক্তি দিলে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা মাদানীর

সর্বাধিক পঠিত

নাটোর-১ আসনে এবি পার্টির প্রার্থীর বিলবোর্ড ভাঙচুরের অভিযোগ
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফের ভূমিকম্প
পাটগ্রাম উপজেলায় সীমান্ত সুরক্ষা জোরদারে 'চতুরবাড়ী বিওপি'র যাত্রা
থাইল্যান্ডে যাচ্ছে তরুণ উদ্ভাবক দল সায়েন্স অ্যান্ড রোবটিকস ক্লাব
ইয়ুথ ফোরামের নবনির্বাচিত কমিটিকে ব্যারিস্টার খোকনের বরণ

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close