মানব জীবনের সবচেয়ে নির্মল, নিষ্পাপ ও সংবেদনশীল সময়কাল হলো শৈশব। এই সময়টাতে মানুষের মধ্যে আত্মপরিচয় বোধ, আত্মবিশ্বাস, এবং সমাজের প্রতি বিশ্বাস, অবিশ্বাস ও ভরসা জন্মাতে শুরু করে। কিন্তু যদি শিশুদের ভালোবাসার পরিবর্তে ভয় দেখানো হয়, তখন তার মনের ভেতর আতঙ্ক তৈরি হয়, স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের পথে সৃষ্টি হয় গভীর ক্ষত- যা পরবর্তীতে সহজে আর পূরণ হয় না। শিশুদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ‘ভয়’ এক বিশাল দেয়াল, যা তাদের আত্মপ্রকাশ, শেখার আগ্রহ ও সৃষ্টিশীলতাকে আটকে দেয়। আজকের বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায়, এই ভয়ভিত্তিক সংস্কৃতি এতটাই গভীরে গেঁথে গেছে যে আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না, আমাদের মনের অজান্তে শিশুদের কতটা মানসিকভাবে ভেঙে দিচ্ছি।
শিশুদের ভয় দেখানোর মাধ্যমে যে ক্ষতই হয় তা কিন্তু সাময়িক কোনো আতঙ্ক নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদি মানসিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতা হয়ে দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু নিয়মিতভাবে ভয় বা মানসিক চাপের মধ্যে বড় হয়, তারা নিজেদের দুর্বল, অক্ষম এবং অবিশ্বাসী হিসেবে ভাবতে শুরু করে। তাদের আত্মসম্মানবোধ গড়ে ওঠে না, আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং তাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও হ্রাস পায়। যখন অভিভাবক বা শিক্ষকই ভয়ের উৎসহয়ে ওঠেন, তখন শিশুর মনে নিরাপত্তাহীনতার সত্তা জন্ম নেয়। ফলে সে অন্যদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে, এমনকি নিজের মনের ভেতরে থাকা ইচ্ছাগুলোও প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করে। এ মানসিক হীনম্মন্যতা পরবর্তীতে উদ্বেগ, ভয়জনিত ব্যাধি ও আত্মমর্যাদাহীনতায় রূপ নেয়, যা শিশুর ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে।
ভয়ের কারণে শিশুর মধ্যে দেখা দেয় মনোযোগে ব্যাঘাত, উদ্বেগজনিত চাপ, ঘুমের সমস্যা এবং আচরণগত অসামঞ্জস্যতা। অনেক শিশু এই ভয় থেকে মুক্তি পেতে আগ্রাসী আচরণ প্রদর্শন করে থাকে, আবার কেউ কেউ নিজেদের সামাজিক ও পারিবারিক পরিবেশ থেকে গুঁটিয়ে নেয়। এভাবে শিশুর প্রাকৃতিক আনন্দ, কৌতূহল এবং শেখার আগ্রহ ধীরে ধীরে মানসিক রোগে রূপান্তরিত হয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুর মস্তিষ্কের জ্ঞানীয় বিকাশের সঙ্গে সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তা ও মানসিক স্থিতিশীলতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যখন শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশে ভয় ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করে, তখন তার মস্তিষ্কের শেখার অংশ- বিশেষত হিপোক্যাম্পাস ও প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স সঠিকভাবে বিকশিত হয় না। ফলে শিক্ষাগত পারফরম্যান্স, মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৫ বছরের কম বয়সি প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে প্রায় ৬ জন, অর্থাৎ ৪০০ মিলিয়নের বেশি শিশু নিয়মিতভাবে বাড়িতে শারীরিক বা মানসিক আগ্রাসনের শিকার। এই ‘মানসিক আগ্রাসন’ মানে যে শুধু মারধর করা তা কিন্তু নয়। ভয় দেখানো, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, অপমান করা কিংবা শাসনের নামে মানসিক চাপ তৈরি করা এর অন্তর্ভুক্ত। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এই পরিসংখ্যান মানব সভ্যতার জন্য লজ্জাজনক চিত্রই তুলে ধরে। আরো উদ্বেগজনক তথ্য হলো ১৯৯০-২০২১ সালের মধ্যে ১০-২৪ বছর বয়সি তরুণদের মধ্যে উদ্বেগজনিত রোগের হার ৫২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার পেছনে শৈশবের ভয় এবং মানসিক চাপকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সমস্যাটা আরো প্রকট। এখানে শিশুদের শাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ভয়কে ব্যবহার করা একরকম সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ১-১৪ বছর বয়সি প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন শিশু অর্থাৎ প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ শিশু প্রতি মাসে সহিংসতার শিকার হয়। এর মধ্যে শারীরিক আঘাত ছাড়াও মানসিক নির্যাতন, ভয় দেখানো, চিৎকার করা, কিংবা অপমান করাও অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের এমআইসিএস ২০১৯ সমীক্ষা অনুযায়ী, ৮৮.৮ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো ধরনের সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের শিশুরা প্রতিদিন এমন এক পরিবেশে বেড়ে উঠছে যেখানে স্নেহ ও ভালোবাসার চেয়ে ভয় বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে।
এ ছাড়াও, বাংলাদেশের ঘরোয়া সংস্কৃতিতে শিশুদের ভয় দেখানো একরকম স্বাভাবিক একটি ব্যাপার হিসেবে দেখা যায়। ‘ভূত আসবে’, ‘পুলিশ ধরবে’, ‘তোমার আব্বুকে/আম্মুকে বলে দেঊষ্ফ এমন বাক্যগুলো অনেক পরিবারের দৈনন্দিন আচরণের অংশ। অভিভাবকরা অনেক সময় বুঝতে পারেন না যে, এই ভয় শিশুর মনে গভীর নিরাপত্তাহীনতা ও হীনম্মন্যতার বীজ বপন করে। একটি শিশু যদি বারবার এই রকম ভয়যুক্ত বার্তা পায় তখন সে নিজের ভেতরেই একটা সীমারেখা টেনে নেয়Ñ সেখানে আর আত্মবিশ্বাসের জায়গা থাকে না। বিদ্যালয়েও একই প্রবণতা দেখা যায়। শিক্ষকরা প্রায়শই কঠোর শাসন বা মানসিক চাপের মাধ্যমে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে চান। কিন্তু বাস্তবে তা শিশুদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়, সৃজনশীলতা নষ্ট করে এবং ভয়ের সংস্কৃতি আরো শক্ত পোক্ত করে তোলে।
শিশুদের জন্য ‘ভয়হীন পরিবেশ’ যেমন নৈতিক চাহিদা, তেমনি এটি তার মৌলিক অধিকার। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি শিশুকে সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক সহিংসতা থেকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের। অথচ বাংলাদেশে এই সুরক্ষা ঘাটতি এখনো বহুলাংশে রয়ে গেছে। স্কুলে ও পরিবারে শিশুদের মানসিকভাবে নিরাপদ পরিবেশ দেওয়ার জন্য অভিভাবক ও শিক্ষকদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষাবিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের বুঝতে হবে, ভয় নয় স্নেহ, উৎসাহ, এবং ইতিবাচক যোগাযোগই শিশুর মধ্যে নৈতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলাবোধ গড়ে তুলতে পারে।
ভয়মুক্ত শৈশব গড়ে তোলার জন্য পরিবার ও সমাজের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সংস্কৃতিতে ‘শাসন মানেই ভয় দেখানো’ এই ধারণা প্রচলিত আছে সেহেতু এটি ভাঙতে হলে প্রথমেই দরকার অভিভাবক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি ও বৃদ্ধি করা। পরিবারে এমন এক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যেখানে শিশুদের ভুলকে অপরাধ নয়, বরং শেখার সুযোগ হিসেবে দেখতে হবে। শিশুরা যেন নির্ভয়ে নিজের ভাবনাগুলো প্রকাশ করতে পারে, নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করতে পারে, এমন সংস্কৃতি গড়ে তোলাই অভিভাবকত্বের প্রকৃত সাফল্যের মানদণ্ড হতে হবে।
অভিভাবকরা যদি বুঝতে পারেন যে তাদের সন্তান কোনো ভুল করেছে, তবে ভয় না দেখিয়ে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর মাধ্যমে সেই সন্তানকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার মতো কার্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। শিশুর মনের মধ্যে ‘আমি ভালোবাসার সন্তান’ এই বিশ্বাস গড়ে উঠলে, সে স্বাভাবিকভাবেই শৃঙ্খলাবোধ শিখতে শুরু করে। একইভাবে বিদ্যালয়গুলোর উচিত শিক্ষকদের জন্য বাস্তবধর্মী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, যাতে করে তারা শিক্ষার্থীদের মানসিক চাহিদা বুঝতে পারেন এবং ইতিবাচক শিখন-শিক্ষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারেন। ‘ভয়ভিত্তিক শিক্ষা’ নয়, ‘উৎসাহভিত্তিক শিক্ষা’ নীতির ভিত্তিতে নতুন পাঠক্রম, শিক্ষক নির্দেশিকা ও বিদ্যালয় নীতি প্রণয়ন করা সময়ের দাবি।
রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কার্যকর নীতিমালা তৈরি করা এবং সেই মানদণ্ড অনুসারে মনিটরিং করা জরুরি। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অন্যতম ইন্ডিকেটর হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মনোসামাজিক সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে প্রশিক্ষিত কাউন্সিলররা শিশুদের ভয়, উদ্বেগ বা মানসিক চাপ মোকাবিলায় সাহায্য করবেন। গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোরও ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ- তাদের প্রচারণায় ‘ভয়মুক্ত শৈশব’কে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, ভয় শিশুর মানসিক বিকাশের সবচেয়ে বড় শত্রু। যে শিশুর শৈশব ভয়, অপমান ও আতঙ্কে পরিপূর্ণ, সে পরিণত বয়সে আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীল সুনাগরিক হয়ে উঠতে পারে না। একটি সমাজের ভবিষ্যৎনির্ভর করে তার শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। তাই যদি আমরা আগামী প্রজন্মকে সাহসী, মানবিক ও ইতিবাচক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তবে আজ থেকেই আমাদের প্রতিটি পরিবার, বিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানকে আতঙ্কমুক্ত শৈশব গঠনের অঙ্গীকার নিতে হবে। ভয় নয়, ভালোবাসাই হোক নিরাপদ শৈশবের মূলমন্ত্র।
লেখক : চিকিৎসক, ছড়াকার ও কলামিস্ট
কেকে/এআর