#বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের প্রভাবে বিবর্ণ জুড়ী নদীর পানি
#বিষটোপে দেশীয় মাছ হুমকির মুখে
#নদীর পানিতে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র দুর্গন্ধ
ভারত থেকে মৌলভীবাজার জেলা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা জুড়ী নদীটি আঞ্চলিক পর্যায়ে মাছ ও জলজ সম্পদের অন্যতম উৎস। প্রতি বছর ভারত অংশ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির মাছে এই নদী হয়ে দেশে প্রবেশ করে। সেই সঙ্গে ভেসে আসে মাছ শিকারিদের টোপের বিষ। সম্প্রতি ভারতের দিক থেকে আসা বিষে জুড়ী নদীর পানি এখন বিষাক্ত। নদী হয়ে তা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা হাকালুকি হাওরাঞ্চলে।
ফলে নদী ও হারাঞ্চালের দেশীয় প্রজাতির মাছ হুমকির মুখে। নদীর পানিতে তীব্র দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ভারতের আসাম ও ত্রিপুরা থেকে জুড়ী নদী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ও ফুলতলা ইউনিয়ন হয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। ফুলতলা ও সাগরনাল ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে মিলিত হয়েছে। ফলে, নদীর এই দূষণ হাকালুকি হাওরের জলজ প্রাণীর জীবনেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
জানা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে ভারত অংশে জেলেরা নদীর পানিতে বিষটোপ ব্যবহার করেন। পানির প্রবাহের সঙ্গে বাংলাদেশের দিকে ভেসে আসা মাছের একটি বড় অংশ শিকার করা হয় সেখানে। সেই বিষ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ অংশে জুড়ী নদী ও হাকালুকির পানিকে বিষাক্ত করছে।
স্থানীয়রা জানান, নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন চা বাগানের শ্রমিকরা কীটনাশক ব্যবহারের পর যন্ত্রপাতি নদীতে ধুয়ে ফেলেন। এতে নদীর পানিতে বিষাক্ত রাসায়নিক মিশে যায়, যা পরিবেশের ওপর আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এলাকাবাসীর দাবি, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে জুড়ী নদী ও এর সংযুক্ত হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দৃশ্যমান এই বিপর্যয় নিয়ে স্থানীয়দের ক্ষোভ সীমাহীন। বিষটোপের বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থে নদীর বাস্তুব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। জলজ উদ্ভিত ও প্রাণীর বংশ বিস্তর কমে গেছে ব্যাপকভাবে। বিষটোপ ব্যবহারের মাত্রা এমন পর্যায়েপৌঁছেছে যে, নদীর পানিতে স্বাভাবিকভাবে কোনোই জলজ উদ্ভিত জন্মাচ্ছে না। ভারত থেকে পানির প্রবাহে মাছ এলেও মারা যাচ্ছে। এতে পানিতে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র দুর্গন্ধ। স্বাভাবিক কাজেও এই নদীর পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সূত্র জানায়, গত ২৭ অক্টোবর থেকে জুড়ী নদীর বিভিন্ন স্থানে মরা মাছ ভেসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। সময়ের সঙ্গে এর পরিমাণ বাড়ছে। মৃত মাছের পচনে নদীর পানি দূষিত হয়ে তীব্র দুর্গন্ধে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন নদী তীরবর্তী বাসিন্দাদের অনেকেই।
জানা গেছে, ভারত সীমান্তঘেঁষা এই নদী জুড়ী উপজেলার জায়ফরনগর, গোয়ালবাড়ী, পশ্চিম জুড়ী, সাগরনাল ও ফুলতলা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে মিলিত হয়েছে। ফলে, নদীর দূষণ এখন হাকালুকি হাওরেও ছড়িয়ে পড়ছে। এতে জলজ প্রাণীবৈচিত্র্য নিয়ে চরম সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, শুকনো মৌসুমে নদীর পানির স্তর কমে গেলে কিছু অসাধু ব্যক্তি মাছ ধরার উদ্দেশ্যে নদীতে বিষ মেশায়। ভারতীয় অংশে বিষ প্রয়োগের পর স্রোতের সঙ্গে তা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের অংশে প্রবেশ করে বিপুল ক্ষতি ডেকে আনে। এই অংশেও মাছ শিকারিদের বড় একটি অংশ একই প্রক্রিয়া ব্যবহার করছে মাছ শিকারে। যার কারণে তীব্র হয়ে উঠছে নদীর দূষণ।
স্থানীয় পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, নদী মনিটরিং ও সীমান্তবর্তী এলাকায় নজরদারি না থাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তারা বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী ব্যবস্থাপনা কমিটির তত্ত্বাবধানে বিষ প্রয়োগ বন্ধের দাবি জানিয়েছেন।
পরিবেশবিদদের মতে, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে জুড়ী নদী ও এর সংযুক্ত হাকালুকি হাওরের জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা ভবিষ্যতে স্থানীয় মৎস্য সম্পদ ও জীবিকার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে।
প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘নদীতে বিষ প্রয়োগ করলে নদীর ইকোসিস্টেম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদীর জীববৈচিত্র্য একে অপরের ওপর নির্ভরশীল-কাদার মধ্যে থাকা ক্ষুদ্র প্রাণী খেয়ে ছোট মাছ বাঁচে, ছোট মাছ খেয়ে বড় মাছ, আর বড় মাছের ওপর নির্ভর করে ভোঁদড়, সাপ, ব্যাঙ ও কাঁকড়ার মতো প্রাণী।’
এ বিষয়ে জুড়ী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, ‘মৎস্য সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইন ১৯৫০ এবং বিধিমালা ১৯৮৫ অনুযায়ী, বিষ প্রয়োগে মাছ নিধন দণ্ডনীয় অপরাধ। এ বিষয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।’
তবে ভারতীয় অংশে বিষ প্রয়োগের ব্যাপকতা রোধে কূটনৈতিক পদক্ষেপ জরুরি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
মনিরুজ্জামান জানান, জুড়ী সীমান্তবর্তী উপজেলা হওয়ায় উজানে, বিশেষ করে ভারতীয় অংশ থেকে মাঝে মাঝে বিষ প্রয়োগের ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি দেশের কিছু অংশেও স্থানীয়ভাবে- এমন ঘটনা দেখা যায়। বিজিবি এ বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। কিছু চা বাগানে কীটনাশক প্রয়োগের পর অবশিষ্ট অংশ নদীতে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে, যা নদীর পানিদূষণ বাড়াচ্ছে। এ বিষয়ে বাগান কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করা হয়েছে।
ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে মাইকিং করে সাধারণ জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তর সর্বদা এ বিষয়ে সতর্ক রয়েছে এবং বিষ প্রয়োগকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির কাজ অব্যাহত রেখেছে।
কেকে/ এমএ