বরিশালের উজিরপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামজুড়ে এখন হাজার হাজার পানের বরজ। বরজগুলোর দিকে উঁকি দিলেই চোখে পড়ে সবুজের সমাহার। কয়েক বছর ধরে পানের চড়া দাম থাকার কারণে চাষিরা এখন পান চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
একসময় যে সব জমিতে ধান, পাট ও গমসহ নানা ধরনের ফসল চাষাবাদ হতো এখন সেই জমিতে গড়ে উঠছে বড় বড় পানের বরজ। লাভজনক ও অর্থকরী ফসল হওয়ায় উজিরপুরের ৯টি ইউনিয়নের মানুষের মধ্যে দিনে দিনে পানের বরজের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। বরিশালের পান সুস্বাদু হওয়ার কারণে দেশ বিদেশে এর চাহিদাও রয়েছে।
উজিরপুরে পান চাষ শুরু হয় প্রায় ২০০ বছর আগে। ইতোমধ্যে পান বেচা কেনার জন্য উপজেলা সদরসহ আশপাশের এলাকায় কয়েকটি বাজার গড়ে উঠেছে। পান চাষ করে বদলে যাচ্ছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের ভাগ্য।
সারা বছর পানের বরজে আয় রোজগার হওয়ায় চাষিরা আগ্রহী হচ্ছেন পান চাষে। পানের বরজে ১২ মাস কাজকর্ম থাকায় এলাকার দরিদ্র দিনমজুরদের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। হাজার, হাজার মানুষ পানের বরজে কাজ করছেন। পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে বরজে দিনমজুরের কাজ করছেন অনেক নারী।
কৃষকেরা জানিয়েছেন, পান চাষে তারা বেশি লাভবান হচ্ছেন পানের বরজ করে পানগাছ লাগানোর চার-পাঁচ মাসের ফলন আসে ওই ফসল সপ্তাহে ২-৩ দিন বাজারে বিক্রি করা যায়। একটি বরজ করলে একটানা ১৫-২০ বছর পান পাওয়া যায়। ফলে, তারা এখন পানের গাছকে ভালোবেসে নাম দিয়েছেন টাকার গাছ হিসেবে।
উজিরপুর উপজেলা সদর, শোলক, গুঠিয়া, শিকারপুর,বরাকোঠা, বামরাইল ও সাতলা ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি পানের বরজ রয়েছে। পানের বাজারকে কেন্দ্র করে উজিরপুরের পৌর এলাকার কালির বাজার, ইচলাদী, সোনারবাংলা বাজার, জয়শ্রী এলাকায় সপ্তাহে তিন দিন করে হাট বসে। এসব হাটে কোটি টাকার পান বেচা-কেনা হয়।
উজিরপুর উপজেলার শোলক গ্রাম যেন পান চাষের অনন্য স্বপ্নভূমি। উপজেলার বেশিরভাগ মানুষই জীবিকা নির্বাহ করেন পানের বরজের উপর নির্ভর করে। এককথায়, শোলকের প্রতিটি ঘরে ঘরেই রয়েছে পানের বরজের ছোঁয়া।
প্রতিদিন সকাল হলে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই নেমে পড়েন বরজের পরিচর্যায়। বছরের পর বছর ধরে এই গ্রামের মানুষরা পান চাষ করে শুধু নিজেদের স্বাবলম্বী করেননি, পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি করেছেন অসংখ্য মানুষের জন্য।
স্থানীয় একাধিক চাষী জানিয়েছেন, এখানকার অধিকাংশ মানুষের প্রধান আয়ের উৎস পান চাষ। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ টাকার পান বিক্রি হয় এই এলাকা থেকে। শুধু স্থানীয় বাজার নয়, বরিশাল ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয় এখানকার প্রসিদ্ধ পান।
পান চাষের কারণে শোলক গ্রামটি ক্রমেই বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের গণ্ডি পেরিয়ে দাঁড়িয়েছে স্বাবলম্বীর নতুন উদাহরণ হিসেবে। গ্রামটি এখন শুধু পানের বরজেই ঢাকা নয়, বরং এখানকার মানুষের কঠোর পরিশ্রম আর সাফল্যের গল্পে ঢেকে গেছে।
উজিরপুর উপজেলার শোলকের পাশাপাশি হারতা, সাতলা, ঘণ্টেশ্বরসহ আরও অনেক এলাকায়ও পান চাষ জনপ্রিয় হলেও শোলক নিজস্ব স্বকীয়তায় আলাদা। এখানে পান চাষের বাম্পার ফলন এবং উন্নত মানই এলাকার অর্থনীতিকে করেছে সমৃদ্ধ।
শোলকের এক প্রবীণ পান চাষী বলেন, ‘আমাদের জীবনের রুটি-রুজি এই পান। এর উপরই ভরসা করে সংসার চলে, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা হয়।’
গ্রামের প্রতিটি বরজ আর চাষির পরিশ্রম মিলে শোলককে আজ পরিণত করেছে এককথায় ‘পানের স্বর্গরাজ্য’তে, যেখানে পানের সুবাসে ভর করে বয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির জোয়ার।
বামরাইলের মোড়াকাঠি গ্রামের পান চাষি মাসুদ জানান, বর্তমানে পানের বাজার ভাল। এ কারণে পান চাষ করে লাভবান হচ্ছেন তারা।
জয়শ্রী বাজারের পানের আড়তদার হানিফ হাওলাদার জানান, তার মোকামে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার পান কোনা বেচা হচ্ছে। বর্তমানে পানের বাজার ভাল। প্রতি বিড়া পান ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে, এলাকার চাষিরা এখন পানের গাছকে টাকার গাছ বলে ডাকেন।
কেকে/এমএ