বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৫৪ একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত বিধান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে। এই ধারা একদিকে পুলিশের জন্য ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতারের ক্ষমতা প্রদান করে আইন প্রয়োগের কার্যকারিতা নিশ্চিত করে, অন্যদিকে নাগরিকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে গভীর প্রশ্ন এবং উদ্বেগ সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে পুলিশের তাৎক্ষণিক গ্রেফতার ক্ষমতা কতটা অপরিহার্য, এবং সেই ক্ষমতার অপব্যবহার হলে ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিধি কোন পরিমাণে সংকুচিত হতে পারে- এ দ্বৈত আলোচনা সময়ের প্রবাহে কখনোই নিস্তেজ হয়নি। ক্ষমতা ও অধিকারের এই টানাপোড়েনই ধারা ৫৪- কে বিচারব্যবস্থা, মানবাধিকার এবং প্রশাসনিক কাঠামোর আন্তঃসম্পর্কের এক সহজাত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করেছে।
তবে ২০২৫ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ এই বিতর্কে এক নতুন মোড় এনেছে। সংশোধনের মাধ্যমে ধারা ৫৪-কে এমনভাবে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে, যাতে পুলিশের কর্তৃত্বের পরিধি স্পষ্ট হয় এবং একই সঙ্গে নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত ও বিধান সংযোজিত হয়েছে। ফলে এটি আর শুধু আইন প্রয়োগের শক্তির প্রতীক নয়; বরং নাগরিক স্বাধীনতা, মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং ন্যায়বিচারের ভারসাম্য রক্ষার এক নতুন দৃষ্টান্ত হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করে। আইনের শাসনের পথে অগ্রসরমান বাংলাদেশে এই সংশোধন শুধু একটি আইনি পরিবর্তন নয়, বরং রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে আস্থার নতুন অধ্যায়ের সূচনা। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা এ ধারা ৫৪-এর সংশোধন, এর প্রয়োগ, সীমাবদ্ধতা ও নাগরিক অধিকার রক্ষার দিকগুলো নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করব।
২০২৫ সালের সংশোধনীতে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৫৪ এক নতুন রূপ লাভ করেছে। বহু আলোচিত এ ধারা এতদিন ধরে মূলত পুলিশের হাতে ওয়ারেন্টবিহীন গ্রেফতারের ক্ষমতা প্রদান করলেও তার প্রয়োগে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। ক্ষমতার সীমারেখা অস্পষ্ট থাকার কারণে নাগরিক অধিকারের প্রশ্নে প্রায়ই তীব্র সমালোচনা দেখা গেছে। নতুন সংশোধনীতে তাই এই ক্ষমতাকে একদিকে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, অন্যদিকে নাগরিক সুরক্ষার জন্য নতুন কিছু শর্ত সংযোজন করা হয়েছে।
নতুন ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি পুলিশের সামনেই কোনো আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটন করে, তবে পুলিশ তাকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করতে পারবে। অপরাধের মুহূর্তে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে এই বিধান নিঃসন্দেহে কার্যকর। তবে শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ অপরাধই নয়, এমন ক্ষেত্রেও গ্রেফতারের বিধান রাখা হয়েছে যেখানে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বা যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ পাওয়া যায় যে কেউ গুরুতর অপরাধে জড়িত।
বিশেষ করে যেসব অপরাধের শাস্তি সাত বছর বা তার বেশি, সেখানে পুলিশকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রেও শর্ত রাখা হয়েছে- গ্রেফতার করতে হলে পুলিশের দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে যে ব্যক্তি সত্যিই অপরাধ করেছেন, এবং সেই গ্রেফতার অপরাধ প্রতিরোধ, তদন্ত পরিচালনা, প্রমাণ সংরক্ষণ, সাক্ষী সুরক্ষা বা আদালতে হাজিরা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যদি গ্রেফতারের প্রয়োজন না হয়, তবে পুলিশ কর্মকর্তা লিখিতভাবে গ্রেফতার না করার কারণ লিপিবদ্ধ করবেন। এটি নিঃসন্দেহে নাগরিক অধিকার রক্ষার পথে এক নতুন অগ্রযাত্রা।
তদুপরি, যদি কারো সাত বছরের বেশি শাস্তিযোগ্য বা মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধের বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়, তবে পুলিশ তাকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করতে পারবে। অপরাধ দমনের জন্য এটি পুলিশের হাতে একটি কার্যকর হাতিয়ার হলেও এর ব্যবহার অবশ্যই আইনের সীমারেখার ভেতরে হতে হবে। এমনকি যদি কোনো ব্যক্তি ঘর ভাঙার সরঞ্জাম অযৌক্তিকভাবে বহন করেন, তবে তাকেও গ্রেফতার করা যাবে এবং সেই সরঞ্জাম বহনের বৈধতা প্রমাণের দায়িত্ব বহন করবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিই। একইভাবে সরকারি আদেশে বা আইনে অপরাধী হিসেবে ঘোষিত কাউকে, সন্দেহজনক চুরি করা সম্পত্তির দখলদারকে কিংবা পুলিশের দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদানকারী ও বৈধ হেফাজত থেকে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিকেও গ্রেফতারের সুযোগ রাখা হয়েছে।
আইনের এই ধারায় সশস্ত্র বাহিনী থেকে পলাতক ব্যক্তিদের গ্রেফতারের বিধানও সংযোজিত হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের ভেতরে বা বাইরে সংঘটিত প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত কাউকে পুলিশের হাতে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। মুক্তিপ্রাপ্ত আসামি যদি আইনের নির্ধারিত শর্ত ভঙ্গ করেন, তবে তাকেও পুনরায় গ্রেফতার করা যাবে। একইসঙ্গে অন্য কোনো পুলিশ কর্মকর্তার রিকুইজিশন বা অনুরোধের ভিত্তিতে গ্রেফতারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, তবে শর্ত হলো রিকুইজিশনে অবশ্যই গ্রেফতারের নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ থাকতে হবে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, নতুন ধারা ৫৪-তে পুলিশের ক্ষমতা যেমন সংরক্ষিত হয়েছে, তেমনি নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত সংযোজন করা হয়েছে। ফলে এই ধারা এখন আর শুধু পুলিশের একতরফা কর্তৃত্বের প্রতিক নয়; বরং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নাগরিক সমাজের মধ্যে এক নতুন ভারসাম্যের প্রতিচ্ছবি। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মৌলিক অধিকার অক্ষুণ্ন রাখার যে দ্বৈত চ্যালেঞ্জ, সংশোধিত ধারা ৫৪ সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এক সুস্পষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ধারা ৫৪-এর সীমাবদ্ধতা
যদিও ধারা ৫৪ নতুন সংশোধনীর মাধ্যমে পুলিশের হাতে গ্রেফতারের ক্ষমতা প্রদান করেছে, তবে তা সীমাহীন নয়। বিশেষত ধারা ৫৪(২) স্পষ্টভাবে নির্দেশ করছে যে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা এই ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবেন কেবলমাত্র নিবারণমূলক আটক বা preventive detention-এর উদ্দেশ্যে নয়। অর্থাৎ, কোনো ব্যক্তি ভবিষ্যতে সম্ভাব্য অপরাধ করতে পারে বলে তাকে আগে থেকেই আটক করা, এমন কোনো কার্যক্রম এই ধারার আওতায় বৈধ নয়।
এই বিধান নাগরিক অধিকার রক্ষার দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। যেহেতু preventive detention বহু সময়ে অত্যধিক কর্তৃত্ব প্রয়োগ ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতো, তাই সংশোধিত ধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- ধারা ৫৪-এর ব্যবহার হতে হবে নির্দিষ্ট ও বৈধ অপরাধের ভিত্তিতে, এবং তার উদ্দেশ্য হতে হবে অপরাধ প্রতিরোধ, প্রমাণ সংরক্ষণ, সাক্ষীর সুরক্ষা বা আদালতে হাজিরা নিশ্চিতকরণ। ফলে এই সীমাবদ্ধতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্ষমতার সঙ্গে নাগরিক স্বাধীনতার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য স্থাপন করে। এটি নিশ্চিত করে যে আইনকে কার্যকর করা হচ্ছে, কিন্তু তা কখনো ব্যক্তির মৌলিক অধিকার বা স্বাধীনতার ওপর অযৌক্তিক প্রভাব বিস্তার করবে না। এই দিক থেকে ধারা ৫৪(২) নাগরিক অধিকারের জন্য একটি সুস্পষ্ট সুরক্ষা বলয় হিসেবে বিবেচিত হয়।
২০২৫ সালের সংশোধিত ধারা ৫৪-এর মাধ্যমে ফৌজদারি কার্যবিধি নতুন এক ভারসাম্য অর্জন করেছে। একদিকে এটি পুলিশের হাতে অপরাধ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা রাখে, অন্যদিকে নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। বিশেষ করে গ্রেফতার না করার কারণ লিখিতভাবে লিপিবদ্ধ করার বিধানটি পুলিশের স্বেচ্ছাচার সীমিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এটি শুধু নথিভুক্তির একটি প্রক্রিয়া নয়; বরং নাগরিক ও রাষ্ট্রের মধ্যে আস্থার একটি চিহ্ন এবং আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের স্বচ্ছতার প্রতিফলন।
তবু এই ধারার প্রভাব ও সফলতা শুধু বিধান সংরক্ষণে সীমাবদ্ধ নয়। তা নির্ভর করবে বাস্তব প্রয়োগে কঠোর নজরদারি, পুলিশের জবাবদিহিতা, এবং আদালতের সক্রিয় ও বিচক্ষণ ভূমিকার ওপর। আইন যদি শুধু লিখিত শব্দে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তার ক্ষমতা ক্ষীণ হয়ে যায়; কিন্তু যখন তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ হয়, নাগরিক অধিকার ও আইনশৃঙ্খলার মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করে, তখনই ধারা ৫৪-এর লক্ষ্য পূর্ণ হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, সংশোধিত ধারা ৫৪ শুধু একটি আইনগত সংযোজন নয়, বরং এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ন্যায় ও দায়িত্বের নতুন এক অধ্যায়।
লেখক : আইনজীবী ও গবেষক;
কেকে/এআর