দেশের অনলাইন পরিসর আজ এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে- তথ্য বিনিময়ের উন্মুক্ত ক্ষেত্র থেকে তা ক্রমেই রূপ নিচ্ছে এক নতুন ‘তথ্য যুদ্ধের ময়দানে’। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিদিনই ছড়িয়ে পড়ছে অসংখ্য ভুয়া ছবি, কার্ড ও ভিডিও- যার অনেকগুলো তৈরি হচ্ছে আধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির সহায়তায়। ফলে মিথ্যা ও বিকৃত তথ্যই হয়ে উঠছে রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার, আর সত্য হারিয়ে যাচ্ছে বিভ্রান্তির আড়ালে। এই প্রবণতা শুধু ব্যক্তিগত বা সামাজিক বিভ্রান্তিই নয়, বরং জাতির গণতান্ত্রিক যোগাযোগব্যবস্থা, নির্বাচনি প্রক্রিয়া ও সামাজিক স্থিতির ওপরও সরাসরি হুমকি সৃষ্টি করছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইট ও বাংলাফ্যাক্টের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলো এই সংকটের গভীরতাকে নতুনভাবে উন্মোচিত করেছে। দেখা যাচ্ছে, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো অনলাইনে তীব্র প্রতিযোগিতায় নেমেছে, যেখানে সত্য ও মিথ্যার সীমারেখা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দল ও তাদের সমর্থকগোষ্ঠী নিজেদের অবস্থান জোরদার করতে গুজব, ভুয়া ফটোকার্ড ও এআই সৃষ্ট ভিডিও ছড়িয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো- এই মিথ্যা তথ্যগুলোর বেশিরভাগই মূলধারার সংবাদমাধ্যমের নাম, লোগো ও রঙ নকল করে ছড়ানো হচ্ছে, যাতে সাধারণ মানুষ সহজেই বিভ্রান্ত হচ্ছে এবং গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে।
এ অবস্থার পেছনে কয়েকটি কারণ স্পষ্ট। প্রথমত, মিডিয়া লিটারেসি বা তথ্যসচেতনতার অভাব- অনেকেই যাচাই না করেই তথ্য শেয়ার করছেন। দ্বিতীয়ত, আইনের দুর্বল প্রয়োগ ও সরকারের নীরবতা- যার ফলে অপপ্রচারকারীরা দণ্ডমুক্তি ভোগ করছে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও ডিজিটাল মুনাফা- ভুয়া কনটেন্টের মাধ্যমে জনমত প্রভাবিত করা এবং ট্রাফিক বা আর্থিক সুবিধা অর্জন করা। এ ছাড়া দেশের বাইরে থেকেও প্রভাব খাটানো হচ্ছে, বিশেষ করে ভারতীয় সামাজিক মাধ্যমের কিছু অংশ থেকে বাংলাদেশকে ঘিরে অপতথ্য ছড়ানো উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।
যদিও নির্বাচন কমিশন সম্প্রতি এআই ভিত্তিক গুজব ও তথ্য বিকৃতি রোধে ২৪ ঘণ্টা কার্যকর একটি কেন্দ্রীয় সেল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে, তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলছে ঘোষণায় নয়, বাস্তবায়নেই আসল পরীক্ষা। শুধু প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিকারই যথেষ্ট নয়; এর সঙ্গে জরুরি হলো- গণসচেতনতা বৃদ্ধি, মিডিয়া শিক্ষা, এবং তথ্য যাচাই প্রক্রিয়াকে (fact-checking) রাষ্ট্রীয়ভাবে শক্তিশালী করা। স্কুল-কলেজ, ধর্মীয় উপাসনালয় ও স্থানীয় প্রশাসনিক পর্যায়েও তথ্য সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা এখন সময়ের দাবি।
আমাদের সমাজে এখন এমন এক ডিজিটাল সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যেখানে ‘বিশ্বাসযোগ্যতার ছদ্মবেশে’ ছড়ানো হচ্ছে মিথ্যা। এর ফল ভয়াবহ, মানুষ বিভক্ত হচ্ছে, আস্থা হারাচ্ছে, আর গুজবের আগুনে জ্বলছে রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সামাজিক সংহতি। এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে, গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড- জনআস্থা ও সুষ্ঠু যোগাযোগব্যবস্থা- চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়বে।
সময় এসেছে রাষ্ট্র, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজ- সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার। গুজব ও এআই সৃষ্ট অপতথ্যের বিরুদ্ধে তথ্যযুদ্ধ এখন কেবল প্রযুক্তিগত নয়, নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্বও বটে। সত্যকে রক্ষা করা মানেই গণতন্ত্রকে রক্ষা করা।
কেকে/এআর