ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে নির্বাচনি মাঠ। এখনো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়নি কিন্তু এরই মধ্যে অনানুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে সম্ভাব্য প্রার্থীরা। তবে এর মধ্যেই নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সহিংসতায় ১১ জনের মতো নিহত হয়েছেন। গত অক্টোবর মাসে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১০ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৫১৩ জন।
বিএনপির দলীয় প্রার্থী ঘোষণার মাত্র দুই দিনের মধ্যেই চট্টগ্রাম-৮ আসনের বিএনপির সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর গণসংযোগে গুলির ঘটনা ঘটে। এতে এরশাদ উল্লাহসহ পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন এবং নিহত হন একজন। নির্বাচন ঘিরে এ সহিংসতা জনমনে উদ্বেগ তৈরি করছে।
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দিয়ে যায়। এর বাইরেও অভ্যুত্থান চলাকালীন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অনেক অস্ত্র লুট হয়। এগুলোর বেশির ভাগ উদ্ধার হয়নি। সীমান্তের ৭টি রুট হয়ে দেশে ঢুকছে আগ্নেয়াস্ত্র। ফলে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে সহিংসতার শঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে।
বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে আমরা দেখতে পাই, ১৯৯১ সাল থেকে দেশে যে আটটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার কোনোটিতেই নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতা এড়ানো যায়নি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে সহিংসতার মাত্রা ছিল সব থেকে বেশি। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় অপেক্ষাকৃত কম সহিংসতার ঘটনা ঘটলেও এই নির্বাচনের আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল চরম উত্তপ্ত।
নির্বাচনপূর্ববর্তী সময় থেকে শুরু করে নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচনপরবর্তী সময়েও এ সহিংসতা দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, যা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং এবারের আসন্ন নির্বাচনে সে চ্যালেঞ্জটা আরো ভয়াবহ। ফলে এ সংকট নিরসনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আগেভাগেই প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। তবে সরকাররে ক্রিয়াশীল কোনো পদক্ষেপ এখনো চোখে পড়েনি।
নির্বাচন ঘিরে সহিংসতার সংস্কৃতি থেকে বের হতে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কর্মীদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখা ও সহিংসতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সমন্বিতভাবে দলীয় ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সাধারণত তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে, মনোনয়নপত্র দাখিল, প্রতীক বরাদ্দ, প্রচারণার সময়, ভোটগ্রহণের সময়কালে সহিংসতা বাড়ে। ভোটের পরও এর রেশ থেকে যায়। প্রতিপক্ষের অফিস ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, প্রার্থী ও কর্মীদের ওপর হামলা, বোমাবাজি এবং মারামারির ঘটনা দেশের নির্বাচনের ইতিহাসে খুবই সাধারণ ঘটনা।
ফলে নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিতে হবে কঠোর অবস্থান যাতে নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই, জাল ভোট প্রদান, ভোটগ্রহণে বাধা দেওয়া, পোলিং এজেন্টদের ওপর হামলা এবং প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের ঘটনাগুলোকে এড়ানো যায়।
সহিংসতা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করে, যা গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তিকে দুর্বল করে। ভোটাররা ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে দ্বিধাবোধ করে, যা ভোটদানের হার কমিয়ে দেয়। সহিংসতা মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন ঘটায়, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকার কারণে দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে। সহিংসতা সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং রাজনৈতিক মেরুকরণকে তীব্র করে। সামগ্রিকভাবে সহিংসতার ঘটনা আমলে নিয়ে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। একইসঙ্গে মনে রাখতে হবে, সহিংসতা থেমে নেই- ফলে এ পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিশ্চিত করা জরুরি। কোনো পরিস্থিতিতেই সহিংসতাকে বাড়তে দেওয়া যাবে না।
নির্বাচনি সহিংসতা সংক্রান্ত সামগ্রিক পরিস্থিতি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে এমনটি কাম্য।
কেকে/ এমএ