বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সন্ধ্যা নদীতে ভাসমান জীবনের এক অনন্য দৃশ্য—নৌকাই যাদের ঘর, সংসার, জন্ম ও মৃত্যু। মানতা সম্প্রদায়— প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যারা নদীর বুকে ভেসে থেকে মাছ ধরে জীবন চালায়। ভূমিহীন এই মানুষগুলোর জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া নেই; নদীই তাদের আশ্রয়, আবার সেই নদীই তাদের চিরনিদ্রার স্থান।
আধুনিক জীবনধারার এই যুগে আধুনিকতার লেশমাত্র স্পর্শ করেনি তাদের। আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে অনেকটা দূরে তাদের বসবাস। নদীর বুকে তাদের জন্ম, নদীতে বেড়ে ওঠা, নদীতেই মৃত্যু। আবার মৃত্যুর পর এতটুকু জমি তাদের নেই যে শায়িত হবে চিরনিদ্রায়, লাশগুলো তাই ভেসে যায় নদীর জলে। নয়তো নদীর তীরে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে রাখা হয়। আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে তাদের অবদান যৎসামান্য, তবু নদী কিংবা সমুদ্রের বুকে মাছ ধরার সব উপকরণ নিয়ে তারা ছুটে চলে জীবনের তাগিদে।
ওরা ভেসে চলে বরিশালের বানারীপাড়াসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদী ও মোহনাগুলোতে। সারাদিন মাছ ধরে আর দিন শেষে ব্যাটারিচালিত টেপ রেকর্ডার নিয়ে বসে ওরা, পুরোনো দিনের সিনেমার গান শোনে তন্ময় হয়ে যায়। কোনো কোনো নৌকায় সৌরবিদ্যুৎ দেখা যায়, দুই তিনটা কম পাওয়ারের লাইট জ্বলে তা দিয়ে।
মানতা সম্প্রদায়ের মানুষদের আজন্ম প্রেম নদীর সাথে, বেঁচে থাকার লড়াইটাও সেই নদীর সাথেই। সামান্য ঝড়ো হাওয়া ওদের মুখ শুকিয়ে দেয়, আগত ঝড় ওদের সামনের দিনগুলোকে বিশাল এক প্রশ্নের মুখোমুখি করিয়ে দেয়। তবুও সেই নদীই তাদের অবলম্বন হয়ে আছে বছরের পর বছর ধরে। এ জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে তারা। আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতো ডাঙায় বসবাস করতে চায় মানতা সম্প্রদায়ের প্রতিটি মানুষ।
তাদের জীবন যেমন, বিবাহরীতিও তেমনি অভিনব। পছন্দের কোনো মেয়েকে তার পিতার নৌকা থেকে নিজের নৌকায় তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়! আবার বনিবনা না হলে স্বামী তার স্ত্রীকে পিতার নৌকায় ফের পাঠিয়ে দেন, পিতার নৌকায় আসলেই হয়ে যায় তালাক! বর্তমানে কিছু কিছু বিবাহ অবশ্য সরকারি খাতায় রেজিস্ট্রি হচ্ছে। কিন্তু মানতা জনপদের কারও জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন হয় না। আবার তাদের বসবাস বাংলাদেশের অসংখ্য নদীতে ছড়ানো ছিটানো বলে তাদের মোট সংখ্যা হিসেব করাও সম্ভব হয়নি।
মানতা সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ গোষ্ঠির ভাসমান জীবনের সূচনা দেড়শো থেকে ২০০ বছর পূর্বে। কোনো কোনো গোষ্ঠি আরো প্রাচীন। এতগুলো বছর পরও তারা পায়নি কোনো স্থায়ী ঠিকানা, এক টুকরো স্থলভূমি। স্থায়ী বাসস্থান তাই ওদের কাছে আজও দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দেয়।
বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে নৌকায় বসবাসকারী ৪০টি মানতা পরিবারের সরদার মো. আবুল কাশেম সরদার জানান, তিনি এ পর্যন্ত পাঁচটি বিয়ে করেছেন। একাধিক বিয়ে করলে লাভ হয়। কারণ, মাছ শিকারে পুরুষের চেয়ে মেয়েরা অভিজ্ঞ।
তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেকে আসেন কথা বলেন। কিন্তু ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। আমরা যেমন নৌকাতে থাকি, তেমনিই আছি।’
আবুল কাশেম জানান, বরিশাল জেলার বানারীপাড়াসহ এ সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার লোক নৌকায় বসবাস করছে।
মানতা সম্প্রদায় প্রসঙ্গে উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা পার্থ সারথী দেউড়ী বলেন, ‘মানতা নামে কাউকে সেবা প্রদানের কোনো নির্দেশনা আমাদের নেই। জেলে সম্প্রদায় যারা আছেন, তাদেরকে সেবা দিচ্ছি। তারপরও আমি মানতাদের সঙ্গে কথা বলব।’
শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি প্রভৃতি মৌলিক অধিকার থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত মানতা সম্প্রদায়। খুব বেশি হলে শতকরা চার কি পাঁচ ভাগ ছেলেমেয়ে পায় প্রাথমিক শিক্ষা। বেশির ভাগই তাই অশিক্ষিত থেকে যায় আজীবন, বয়স ১০ কি ১২ হলেই বাবা মায়ের পেশা মাছ ধরাকে নিজের পেট চালানোর অবলম্বন করে নেয়। নয়তো খাবার জোটে না প্রতিদিন। রাষ্ট্রে অসাধারণ রেজাল্ট নিয়ে বেড়ে উঠছে এক প্রজন্ম, অথচ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এক বিশাল জনগোষ্ঠি যে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
মানতা সম্প্রদায়ের বড় একটি সমস্যা খাবার পানি। বিশুদ্ধ খাবার পানির ভীষণ সংকট ওদের মাঝে। কারণ, নদীর পানিতেই চলে রান্নাবান্না, বাসন আর কাপড় পরিষ্কার। মলত্যাগও সেখানেই। তাই, নিয়মিত পানিবাহিত রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে স্থানীয় সরকারি হাসপাতালমুখী হন মানতারা। কিন্তু চিকিৎসা সেবা মেলে না। আর শহুরে বড় হাসপাতালে চিকিৎসা করাবে সে ক্ষমতা ওদের কোথায়? তাই বাধ্য হয়ে নিজস্ব চিকিৎসায় আশ্রয় গ্রহণ করে তারা, যার ফলাফল হয় ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যু।
নগর সভ্যতার এ যুগে মানুষ বসবাসের জন্য গড়ে তুলছেন একের পর এক পাহাড় সমান অট্টালিকা। নিরন্তর ছুটে চলেছেন আরও উন্নত জীবনযাপন, আরাম-আয়েশের খোঁজে। ঠিক একই সময়ে কারও নৌকায় জন্ম, বিয়ে, সংসার ও মৃত্যুর কথা শুনলে কিছুটা থমকে দাঁড়াতে হয়। এমন ব্যতিক্রম চিত্রও রয়েছে।
নদী কিংবা সাগরে নৌকায় ভেসে ভেসে মাছ শিকার করে চলে তাদের জীবন সংসার। যে নদীর পানিতে জীবন, সেখানেই মৃত্যু। এ যেন জলের জীবন। এটাই তাদের নিয়তি।
কেকে/ এমএ