ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদের রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে আবেদন করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) বীর মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ আবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তির করা আবেদনপত্রে বলা হয়েছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদ ছিলেন আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার ঘনিষ্ঠজন।
এতে বলা হয়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বড় বড় প্রকল্পের ‘অবিকল্প’ ঠিকাদার তিনি। অস্বাভাবিক লেনদেনের কারণে আলোচনায় আসেন বশির আহমেদ। ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যাংক হিসাব তলব করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আওয়ামী লীগ আমলে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কোনো কাজের ফল শুভ হয়নি। বাঁধ নির্মাণের পর হয় ধসে গেছে, নয়তো নদীতে বিলীন হয়েছে। রাস্তা নির্মাণের পর নষ্ট হয়েছে সামান্য বৃষ্টিতে। ড্যাম নির্মাণের পর খুলে গেছে রাবার। কুঠিবাড়িতে বিশ্বকবির স্মৃতি সংরক্ষণ প্রকল্পেও হয়েছে অনিয়ম। এমনকি চর না কেটেই অর্থ লোপাটের অভিযোগও রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ দেশের বিভিন্ন নদনদীর ভাঙন ঠেকাতে বাঁধ নির্মাণ ও সংরক্ষণ, নদী খনন, সড়ক নির্মাণ, মেরামতসহ নানা রকম প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি। ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিভিন্ন প্রকল্পে নানা ধরনের গলদের চিত্র পাওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং সারাদেশে ১০০টির অধিক প্রকল্পের কাজ করেছে। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশই পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নানা প্রকল্প। কোনো প্রকল্প প্রস্তুত হতেই বশির আহমেদ এসে হাজির হতেন। অবস্থা এমন যে, প্রকল্প তৈরিই হয় যেন তার জন্য। সেখানে টেন্ডারবাজি হতো না, হতো ‘বশিরবাজি’।
বশির আহমেদের উত্থানের গল্পও বেশ চমকপ্রদ। স্কুলশিক্ষক বেলায়েত হোসেনের ছেলে বশির আহমেদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা এলাকায়। একাত্তরে বিতর্কিত ভূমিকা পালনকারী এক ব্যক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রায় তিন দশক আগে ঠিকাদারি কাজ শুরু করেন বশির। বহু বছর তিনি ছোটখাটো প্রকল্পের ঠিকাদারি করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাসীন হলে নিজের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে সখ্য গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে। তখন তার ঠিকাদারি জেলা ছাড়িয়ে বিস্তৃত হতে থাকে সারাদেশে।
দাপটের সঙ্গে একের পর এক প্রকল্প নিজের কবজায় নেন বশির আহমেদ। ঠিকাদারির পাশাপাশি আরও বেশ কয়েকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানও রয়েছে তার। এর মধ্যে আইবিসি পাওয়ার অন্যতম। এই আইবিসির চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য এইচ বি এম ইকবাল ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদ। আরও রয়েছে ওয়েস্টার্ন রিনিউঅ্যাবল এনার্জি, ভিনসেন কনসালট্যান্সি, দ্য ইমপেরো প্রপার্টিজ, ভিনসেন জিটেক লিমিটেড, ওয়েস্টার্ন ড্রেজেটেক প্রাইভেট লিমিটেড।
প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা রকম অনিয়ম দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরও নতুন প্রকল্পের ঠিকাদারি পেতে বেগ পেতে হয় না বশির আহমেদের। কারণ ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তা ছাড়া পাউবোর ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গেও রয়েছে তার নিবিড় যোগাযোগ।
সারাদেশে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং যে প্রকল্পের কাজ করছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে তালিমনগর ড্রেনেজ ও সেচ পাম্প হাউস নির্মাণ, মেঘনার তীরে রামগতি ও কমলনগরে বাঁধ সংরক্ষণ, চরফ্যাসন পৌরশহর রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ, তজুমদ্দিন উপজেলা সদরে নদীতীরে বাঁধ নির্মাণ, যমুনার ভাঙন থেকে গাইবান্ধা ও ফুলছড়ি রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নতকরণ, ফেনী-নোয়াখালী চার লেন সড়ক নির্মাণ, কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, বাঁকখালী নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ড্রেনেজ ও সেচ, গজারিয়া ৩৫০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্লান্টের ভূমি উন্নয়ন, মেলান্দহে শেখ হাসিনা টেক্সটাইল কলেজ নির্মাণ, মাদারগঞ্জে শেখ হাসিনা স্পেশালাইজড জুট টেক্সটাইল মিল নির্মাণ, গাজীপুরে ৩৫ হাজার প্রিপেইড মিটার সরবরাহ প্রকল্প।
এ ছাড়া আরও অন্তত ১২টি প্রকল্পের ঠিকাদারি পাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে জামালপুরের ইসলামপুরে যমুনা নদীর বাম তীর সংরক্ষণ ও ড্রেজিং, চাঁদপুরে নতুন পাম্প হাউস নির্মাণ কাজ, কক্সবাজারের পেকুয়ায় পাওয়ার প্লান্টের ভূমি উন্নয়ন, সিলেট বিভাগে টেক্সটাইল কলেজ নির্মাণ, চট্টগ্রামের সাঙ্গু নদী খনন, ভোলার বিভিন্ন নদী খনন, বরিশালের লেবুখালী ক্যান্টনমেন্টে ভূমি উন্নয়ন কাজ।
বাস্তবায়িত প্রকল্পে যত গলদ :কুষ্টিয়ার শিলাইদহে কুঠিবাড়ি এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির বাস্তবায়িত প্রকল্পের খোঁজ নিলে জানা যায়, কাজ শেষ হওয়ার বছর না ঘুরতেই দুই দফায় প্রায় দেড়শ' মিটার বাঁধ চলে যায় পদ্মার পেটে। ফলে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। একই সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগও ভেস্তে যেতে বসেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং জনপ্রতিনিধিরাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনিয়ম, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার থেকে শুরু করে গোটা প্রকল্পে নয়ছয় করার অভিযোগ তোলেন। দুই কোটি টাকা জরিমানাও করা হয় এ প্রতিষ্ঠানকে।
২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর বগুড়া সফরে গিয়ে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার কয়েকটি প্রকল্প উদ্বোধন করেন তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার মধ্যে ছিল সারিয়াকান্দি উপজেলাধীন কুর্নিবাড়ী-কুতুবপুর-রহদহ-কামালপুর এলাকায় যমুনা নদীর ডান তীরে বিআরই বিকল্প বাঁধ নির্মাণ কাজ, অন্তরপাড়া, দড়িপাড়া এবং পাশের এলাকায় যমুনা নদীর ডান তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংরক্ষণ প্রকল্প। এটিও বাস্তবায়ন করে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং। তবে উদ্বোধনের পরের বছরই শুরু হয় ভাঙন। ঝালকাঠির সুগন্ধা, গাবখান ও ধানসিড়ি নদীর মোহনায় জেগে ওঠা চরের কারণে জলযান চলাচল একমুখী হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বেগ পেতে হয় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্মাণসামগ্রী সরবরাহে। সে জন্য গত বছর চ্যানেলের প্রস্থ বাড়ানো এবং চর অপসারণের উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রকল্পের কাজ পায় ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের কারণেই বাঁধের কাজ টেকসই হয়নি। প্রকল্পের কার্যাদেশ অনুযায়ী নদীর ভেতরে ৪৫ মিটার জিও ব্যাগ ডাম্পিং ও যথাযথভাবে ব্লক স্থাপনের কথা থাকলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দায়সারাভাবে কাজটি শেষ করে। কক্সবাজারের চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদীর ওপর ৩২ কোটি টাকার রাবার ড্যাম প্রকল্পও বাস্তবায়ন করে প্রতিষ্ঠানটি। দুই বছর পার হওয়ার আগেই খুলে যায় ড্যামের রাবার। ওই ড্যাম এখন কোনো কাজেই আসছে না। মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি ইউনিয়নের রাজঘাট এলাকায় তিন কোটি ৮২ লাখ টাকার ৪১৪ মিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ করে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং।
২০২২ সালের ২২ আগস্ট ৪৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং (প্রাইভেট) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশীর আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থার উপ-পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ মামলাটি দায়ের করেন। তারপরেও থেমে থাকেনি বশির আহমেদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক কমিশনার মো. জহুরুল হক বিভিন্ন সময়ে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির মালিক বশির আহমেদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। রাজধানীতে জহুরুল হককে বাড়িও করে দিয়েছিন বশির আহমেদ। যার কারণে আওয়ামী লীগ আমলে বশির আহমেদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার কোনো অগ্রগতি হয়নি। বর্তমানেও দুদকের কয়েকজন কর্মকর্তাকে তিনি ম্যানেজ করে চলেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণে আপনার মর্জি কামনা করছি।
কেকে/ এমএস