মৌলভীবাজার জেলায় প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) বিকালে জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ৭ দিনের এ উৎসব শেষ হয়।
জানা গেছে, এ বছর মৌলভীবাজার জেলার সাতটি উপজেলায় মোট ১ হাজার ১০টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ১০৯, শ্রীমঙ্গলে ১৭০, কমলগঞ্জে ১৫৩, রাজনগরে ১৩৭, বড়লেখায় ১৪৫, জুড়ীতে ৭৫ এবং কুলাউড়ায় ২২১টি মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
পূজায় কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন।
প্রশাসন জানায়, দুর্গাপূজা নির্বিঘ্ন করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী মাঠে ছিল।
এ বছরও জেলার বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। বিশেষ করে জেলার শ্রীমঙ্গল ও জুড়ী উপজেলায় একই উঠানে অবস্থিত পৃথক দুটি ধর্মীয় উপাসনালয় জেলাজুড়ে সম্প্রীতির শিক্ষা ছড়াচ্ছে। একটি হল শ্রীমঙ্গলের ভৈরবগঞ্জ বাজারের অবস্থিত মাজদিহী জামে মসজিদ ও শ্রী শ্রী মহাদেব ভৈরব মন্দির এবং অপরটি হলো জুড়ীর ভূঁয়াই বাজার জামে মসজিদ ও ভূঁয়াই বাজার সর্বজনীন দুর্গা মন্দির।
স্থানীয়রা জানান, ভৈরববাজারে একই আঙিনায় ৭৮ বছর ধরে কোনো ধরণের সাম্প্রদায়িক কলহ বা দাঙ্গা ছাড়াই দুই ধর্মের মানুষ তাদের ধর্ম পালন করে আসছেন নির্দ্বিধায়। এভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যুগ যুগ ধরে চলছে পৃথক দুটি ধর্মীয় উপাসনালয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভৈরবগঞ্জ বাজারে মাত্র কয়েক গজের ব্যবধানে গড়ে উঠেছে ভৈরব মন্দির আর মাজদিহি জামে মসজিদ। মসজিদের মিনার আর মন্দিরের চূড়া দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন এটি। ৭৮ বছর বছর ধরে এখানে শান্তিপূর্ণভাবে দুই ধর্মের মানুষ যে যার ধর্ম পালন করে আসছেন। পাশাপাশি, মন্দির ও মসজিদ থাকায় এখানকার দুই ধর্মের মানুষই একে অন্যের ধর্ম সম্পর্কেও অভিজ্ঞতা নিতে পারছেন। সম্প্রীতির শিক্ষা ছড়াচ্ছে এই দুই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে এখানে মন্দির নির্মাণ করা হয়। ৭৮ বছর আগে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। গত ৭৮ বছরে দেশব্যাপী বহু সাম্প্রদায়িক উসকানি ঘটলেও তার প্রভাব এখানে পড়েনি। দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এক সঙ্গে প্রায় ২০ গজের ব্যবধানে সহাবস্থানে রয়েছে। এই দীর্ঘ সময় দুই ধর্মের মানুষ কাছাকাছি অবস্থানে ধর্মকর্ম পালন করে গেলেও এখানে কোনো সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি বিনষ্টের ঘটনা ঘটেনি।
ভৈরববাজারের বাসিন্দা মুস্তাকিম আল মুন্তাজ বলেন, ‘দুই ধর্মের মানুষ কাছাকাছি দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থান করে নিজ নিজ ধর্ম পালন করছেন। এখানে কোনো ধরণের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘটনা ঘটেনি বা সমস্যা হয়নি। মন্দিরে প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত পূর্জা ও কীর্তন হয়। এতে কারও কোনো সমস্যা হয় না।’
মন্দির কমিটির লোকজন বলেন, ‘এখানে ধর্মীয় সম্প্রীতি অটুট ছিল, আছে ও ভবিষ্যতেও থাকবে। কোনো দিনই এই সম্প্রীতিতে কোনো দাগ পড়েনি আর পড়বেও না। সারা বিশ্বেও যদি ধর্মীয় সহিংসতা বাধে, তবু এখানকার ধর্মীয় সম্প্রীতি থাকবে অটুট। এটাই আমাদের বিশ্বাস।’
মসজিদ কমিটির লোকজন জানান, শ্রীমঙ্গল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে পাশাপাশি মসজিদ ও মন্দির হলেও যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণভাবে দুই ধর্মের মানুষ যে যার ধর্ম পালন করে আসছেন। এখানে কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি।
কালাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মতলিব বলেন, ‘এই মন্দিরের পাশেই এক সময় বাজার গড়ে ওঠে। যা এখন ভৈরব বাজার নামে পরিচিত। লোকমুখে প্রচলিত তথ্য মতে, প্রাায় ২০০ বছর আগে পূণ্যদত্তের পরিবার ভৈরব মন্দির স্থাপন করেছিলেন। এরপর এখানে মসজিদ স্থাপন করা হয় ১৯৪৭ সালের দিকে। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই দুই ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মকর্ম পালন করে যাচ্ছেন।’
একইভাবে সম্প্রীতির শিক্ষা ছড়াচ্ছে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ‘ভূঁয়াই বাজার জামে মসজিদ’ ও ভূঁয়াই বাজার সর্বজনীন দুর্গা মন্দির’। উপজেলার জায়ফরনগর ইউনিয়নের জুড়ী-কুলাউড়া সড়কের ভূঁয়াই বাজারে একই উঠানে অবস্থিত পৃথক দুটি ধর্মীয় উপাসনালয়। দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে দুই ধর্মের মানুষ যে যার ধর্ম পালন করে আসছেন।
জানা যায়, ১৯৭৩ সালে এলাকাবাসীর উদ্যোগে পাশাপাশি নির্মাণ করা হয় মসজিদ ও মন্দির। আজান শুনে এলাকার মুসল্লিরা নামাজ পড়তে আসেন এ মসজিদে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পূজা-অর্চনা চলে পাশের মন্দিরে। এভাবেই চলে আসছে পাঁচ দশক ধরে। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন নিয়ে কখনো বিরোধ হয়নি দুই ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে। বরং দাঁড়িয়ে আছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সাক্ষী হয়ে।
স্থানীয়রা জানান, পূজা শুরুর আগে মসজিদ ও মন্দির কমিটি বসে সিদ্ধান্ত নেয়। নামাজ বা আজানের সময়সূচি অনুযায়ী পূজা-অর্চনার ঢাক বাজানো বন্ধ রাখা হয়। নামাজ শেষে পূজার কার্যক্রম আবার শুরু হয়। এ কারণে এখন পর্যন্ত এই মসজিদ-মন্দিরের প্রাঙ্গণে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
ভূঁয়াই বাজার সর্বজনীন দুর্গা মন্দির কমিটির সভাপতি পীযূষ কান্তি দাশ বলেন, ‘প্রায় ৪৫ বছর আগে এলাকাবাসীর উদ্যোগে একই সঙ্গে মসজিদ ও মন্দির নির্মাণ করা হয়। এ রকম পাশাপাশি মসজিদ-মন্দির আর কোথাও আছে কি না জানা নেই। এখানকার হিন্দু-মুসলমানরা মিলেমিশে আছি। মন্দিরে পূজার সময় মুসলমান ভাইদের নিমন্ত্রণ করি, তারা আসেন, নানাভাবে সহযোগিতাও করেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠান করা নিয়ে আমাদের মধ্যে কখনো বিরোধ বা সংঘাত হয়নি।’
মসজিদের মুসল্লিরা বলেন, ‘মন্দিরে পূজা চলে। মসজিদে নামাজ আদায় করি আমরা। এতে কারও কোনো সমস্যা হয় না। এইটা আমাদের বহু দিনের ঐতিহ্য।’
ভূয়াই জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা সিরাজ উদ্দিন বলেন, ‘আমি ১৯ বছর ধরে এই মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমাদের এখানে একই উঠানে দুইটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এখানে মুসলমান এবং হিন্দুরা যে যার ধর্ম সুষ্ঠুভাবে পালন করছেন। আমরা নামাজ পড়ছি, তারা পূজা করছেন। কেউ কারো ধর্মে কোনো হস্তক্ষেপ করছেন না। কোনো বিশৃঙ্খলা ছাড়াই বহু বছর ধরে চলছে এ সম্প্রীতির বন্ধন।’
স্থানীয় পূজা আয়োজকরা জানান, জেলার প্রতিটি পূজা মণ্ডপে ধর্মীয় উৎসব আনন্দঘন পরিবেশে উৎসব সম্পন্ন হয়েছে।
তারা আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতেও এ সম্প্রীতি অটুট থাকবে।
জেলার পুলিশ সুপার এমকেএইচ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘মৌলভীবাজার জেলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে জেলার জুড়ী ও শ্রীমঙ্গলে একই উঠানে মসজিদ ও মন্দির ধর্মীয় সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত। এবার পূজাকে ঘিরে মৌলভীবাজার জেলায় কঠোর নিরাপত্তা ছিল। কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে পূজা সম্পন্ন করেছেন।’
মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মো. ইসরাইল হোসেন বলেন, ‘মৌলভীবাজার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল উদাহরণ। এ জেলায় একসঙ্গে মসজিদ ও মন্দির থাকলেও কখনো কোনো বিশৃঙ্খলা হয়নি। এবারও শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গোৎসব পালিত হয়েছে। এমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভবিষ্যতেও অটুট রাখতে হবে।’
কেকে/ এমএ