শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে মানিকগঞ্জ সদরের ১১৭টি পূজামণ্ডপের প্রতিটির জন্য সরকারিভাবে ৫০০ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের এই বরাদ্দে মোট চালের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৫৮ টন। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, এ চাল ভক্ত ও দর্শনার্থীদের আপ্যায়নে ব্যবহার করার কথা থাকলেও পূজামণ্ডপে বরাদ্দকৃত চাল নিয়ে চলছে চালবাজি।
অভিযোগ উঠেছে, সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে চাল নিয়ে গড়ে উঠেছে প্রভাবশালীদের একটি সিন্ডিকেট। সদর উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফজলুল হক, মানিকগঞ্জ জেলা যুবদলের প্রভাবশালী এক নেতার ভাই বিএনপি কর্মী হিসেবে পরিচয় দানকারী বেওথার খায়রুজ্জামান লিটন ও আরেক প্রভাবশালী বিএনপি নেতার ভাই দাশড়ার বাবু এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, তাদেরকে চাপ প্রয়োগ করে চাল বিক্রি করতে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রতি ৫০০ কেজি চাল ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা দামে কিনে নিচ্ছেন ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। অথচ সরকারি দরে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৪৯ টাকায় ৫০০ কেজি চালের দাম ২৪ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু পূজামণ্ডপের এই চাল বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৩৬ টাকা কেজি দরে, যার আনুমানিক বাজার মূল্য ১৮ হাজার টাকা। চাল বিতরণে আনুষ্ঠানিকভাবে নিয়োজিত আছেন সদর খাদ্য গুদামে ২ জন ট্যাগ অফিসার এবং উপজেলাজুড়ে ১০টি ইউনিয়নে ১০ জন ট্যাগ অফিসার পরিদর্শনপূর্বক পূজা পরবর্তীতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া নির্দেশনা রয়েছে। সরকারি নির্দেশনা আছে বিধায় মন্দির কমিটির প্রধানরা চাল আপাতত নিয়ে গেছে। পূজা পরবর্তীতে সেই চাল আবার সিন্ডিকেটের হাতে চলে যাবে অভিযোগ রয়েছে।
রাজনগর মধ্যপাড়া সার্বজনীন পূজা মণ্ডপের সভাপতি জানান, প্রথমে সানোয়ার নামে এক ব্যক্তি আমাদের মন্দিরে পাঁচ হাজার টাকা অনুদান দেয়। পরের দিন ডিও লেটার দিয়ে চাল নেয়ার সময় সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুল হক পরিচয় দিয়ে চাল কেনার কথা বলে। পরে আরো ১৩ হাজার টাকা দিয়ে মন্দিরের চাল নিয়ে যান তিনি।
শ্যামনগর পূজা মণ্ডপের সভাপতি গৌর কুমার সাহা বলেন, বিভিন্ন পূজামণ্ডপের চাল একেকজনের কাছে বিক্রি করছে। তখন পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি গোরাংঙ্গ সরকার চাল বিক্রি প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে, আমরা যার কাছ থেকে টাকা নিয়েছি তার কাছে টাকা ফেরত দিব। পরে তিনি চাল বিক্রি করলে লিটনের কাছে চাল বিক্রির করার কথা বলে। পরে আমি লিটনের কাছে ১৮ হাজার টাকায় চাল বিক্রি করছি।
আলীনগর রাজবংশীপাড়া সার্বজনীন দূর্গোৎসব যুগ্ম সাধারন সম্পাদক অজয় শীল জানান, আমাদের বরাদ্দের চাল সরাসরি দর্শনার্থীদের খাওয়ানোর কাজে ব্যবহার করার কথা। কিন্তু চাল খারাফ হবে কিনা তাই ভালো চাল কিনে দর্শনার্থীদের জন্য ভোগ রান্না করছি। পূজা শেষ হলে আমরা এই চাল বিক্রি করে দিব। সবাই এই চাল বিক্রি করছে। পূজামণ্ডপে চাল রাখার সরকারি নির্দেশনা আছে বিধায় পূজা শেষ হলে তাদেরকে চাল দিয়ে দিতে হবে।
চাল কেনার কথা স্বীকার করে খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, আওয়ামী লীগের সময় ১৬ বছর আমরা ব্যবসা করতে পারিনি। আমি ছাড়াও এই ব্যবসা করছেন সদর উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফজলুল হক ও জাহাঙ্গীর। এই চাল মন্দিরের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকরা আমাদের কাছে বিক্রি করছে। তাতে আইনগত বাধা নাই। আমরা কারো কাছ থেকে জোরপূর্বক কিনছি না।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফজলুল হক বলেন, আমার সুনাম নষ্ট করার জন্যেই কেউ শত্রুতা বসতঃ চাল কেনার কথা বলেছে। আমি এই চাল কেনার সাথে জড়িত নই। আমি আমার ইউনিয়নের ১৭ টি পূজামণ্ডপের ডিও লেটার একদিন সময় বাড়ানোর জন্য এবং একসাথে একটি পিকআপ ভ্যানে করে নেয়ার কথা বলেছি সদর এল এস ডি কর্মকর্তাকে। পরে তিনি এভাবে নেওয়ার বিষয়ে মানা করায় ওইখান থেকে চলে এসেছি।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ মেজবাহ উল সাবেরিন বলেন, আমরা এই কার্যক্রমে শুরু থেকেই স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিয়ে কাজ করেছি এবং মন্দিরে মন্দিরে ট্যাগ অফিসার নিয়োগ করে দিয়েছি। এরপরও কার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। সরকারি স্বার্থেই এ সিন্ডিকেট ভাঙ্গতে হবে।
জেলার সাতটি উপজেলার ৫৫৫ টি মন্দিরেই এ চাল বিক্রি হয়েছে আর কিনে নিয়েছেন সিন্ডিকেটচক্র। পূজামণ্ডপে বরাদ্দকৃত চাল কালোবাজারিতে চলে যাওয়ায় সরকারের সহায়তা বিতরণ কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। রাজনৈতিক নেতা, খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মন্দির কমিটির একটি অংশের যোগসাজশেই এ ধরনের অপকর্ম চালু রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন সচেতন মহল।
কেকে/ এমএস