রোববার, ১২ অক্টোবর ২০২৫,
২৭ আশ্বিন ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

রোববার, ১২ অক্টোবর ২০২৫
শিরোনাম: ১১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার      জিয়া পরিবার জনগণের পরিবার : আমান উল্লাহ      রোমে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা      ২০০ তালেবান সৈন্যকে হত্যার দাবি পাকিস্তানের      বাতিল হওয়ার শঙ্কায় বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার ভারত সফর      বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে দেশে স্বৈরশাসন পাকাপোক্ত হয়েছিল      প্রেসক্লাবে শিক্ষকদের ছত্রভঙ্গে সাউন্ড গ্রেনেড-লাঠিচার্জ      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
বিএনপির বর্তমান সংকট ও উত্তরণের পথ
ফাহিম হাসনাত
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ১১:১৭ এএম
ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

১. বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগের পর যদি কোনো দল দীর্ঘকাল ধরে আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করে থাকে, তবে সেটি হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে জন্ম নেওয়া এ দলটি একাধিকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় গিয়েছে এবং বারবার ক্ষমতার পালাবদলে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ, যা তাদের রাজনৈতিক ভিত্তিকে আরো মজবুত করেছিল। পাশাপাশি, ২০২৪ এর জুলাই আন্দোলনে দলটির অসীম সাহসিকতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অনিবার্য শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে ২০২৪ সালের এ বিপ্লব দেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আমূল পরিবর্তনও এনেছে। 

আওয়ামী লীগের পতনের মাধ্যমে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলে পরিণত হলেও, এ অবস্থান তাদের জন্য যতটা অর্জন, ততটাই চ্যালেঞ্জও বয়ে এনেছে। ক্ষমতার পালাবদলের এ প্রেক্ষাপটে বিএনপিকে এখন শুধু একটি বিরোধী শক্তি নয়, বরং একটি বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হচ্ছে। আর সেই প্রক্রিয়ায় দলের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও দ্বন্দ্বগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় বিএনপির ভেতরে নেতৃত্বের সংকট এবং প্রজন্মগত ব্যবধানও প্রকট আকার ধারণ করেছে। দলটির সবচেয়ে বড় এবং প্রধান সংকট হলো নেতৃত্বের দুর্বলতা ও শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তৃণমূলের ব্যাপক দূরত্ব। 

দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘদিন ধরে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি নিজেকে বিকল্প নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন ঠিকই, কিন্তু মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন। যারা দীর্ঘদিন ধরে রাজপথে আন্দোলন করেছেন, কারাবরণ করেছেন এবং জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রেখেছেন, তাদের কাছে দূরবর্তী নির্দেশনা প্রায়ই অকার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতারা এ নির্দেশনা যথাযথ আন্তরিকতার সঙ্গে নয়, বরং নিজেদের সুবিধা এবং সুযোগ মতন মেনে চলছেন।

২.
এই নেতৃত্ব সংকটের কারণে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা, বিভ্রান্তি এবং অনাস্থা সৃষ্টি হয়েছে। তারা মনে করেন, তাদের ত্যাগ এবং কষ্টকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। বরং, আন্দোলনের জন্য নয়, বরং কেন্দ্রীয় নেতাদের খুশি করার জন্য একটি প্রতিযোগিতা চলছে। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন না করে রাজধানীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের কাছে নিজেদের প্রমাণ করতে ব্যস্ত। ফলস্বরূপ, মেধাবী ও ত্যাগী নেতারা অবহেলিত হচ্ছেন, যা দলের সাংগঠনিক ও নৈতিক শক্তিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতারা কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছেন। তাদের হাতে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নেই এবং প্রায়শই এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয় যা স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। নেতৃত্বের সংকটের পাশাপাশি বিএনপির অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক দুর্বলতাও সুস্পষ্ট। 

দলের নাম ব্যবহার করে একশ্রেণির অসাধু নেতা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করছেন। এই নেতারা চাঁদাবাজি, দখলদারি এবং অন্যান্য অবৈধ কর্মকাণ্ডে লিপ্ত, যার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করছেন। এই ধরনের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের চোখে কখনোই গোপন থাকে না এবং এর ফলে দলের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দলের পক্ষ থেকে এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা প্রায়শই নামমাত্র। যা পদচ্যুতি বা সাময়িক বহিষ্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অপরাধ প্রমাণিত হলেও রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক জটিলতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এ পরিস্থিতি শুধু দলের নৈতিক অবনতি ঘটায় না, বরং সাধারণ মানুষের বিশ্বাস ও আস্থাও কমিয়ে দেয়। কিছু শীর্ষ নেতা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য এমন অসাধু নেতাদের সঙ্গে আপস করেন। পদচ্যুত বা বাদ পড়া নেতাদের সুবিধা দানের মাধ্যমে তারা নিজেদের সমর্থন নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। এটি সংগঠনকে আরো বিভ্রান্ত করে এবং শৃঙ্খলা ও নৈতিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ দুর্নীতি এবং নৈতিক অবক্ষয় তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে এবং দলের প্রতি তাদের আস্থা কমিয়ে দেয়। ত্যাগী কর্মীরা যখন দেখেন যে, যারা অন্যায় করছে তারা পার পেয়ে যাচ্ছে এবং সুবিধাবাদী ও অযোগ্য ব্যক্তিরা দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করছে, তখন তাদের মনোবল ভেঙে যায়। 

বিএনপির বর্তমান সংকট কেবল প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্রের ফল নয়, বরং তাদের নিজেদের ব্যর্থতা, দুর্বলতা, বিভাজন এবং অপরিকল্পিত পদক্ষেপের ফল। দলটি দীর্ঘদিন ধরে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের পরিবর্তে ক্ষমতাধরদের সঙ্গে জোট গঠনের ওপর বেশি জোর দিয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বেড়েছে। জনগণ যখন দেখছে যে তাদের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকায় দুর্নীতিবাজ নেতারা ফায়দা লুটছে এবং কোনো প্রকার জবাবদিহিতা ছাড়াই পার পেয়ে যাচ্ছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই তারা এ দলের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। দলটির আরো একটি বড় ভুল হলো আত্ম-সমালোচনার অভাব। নিজেদের ভুলত্রুটি স্বীকার করে তা সংশোধনের পরিবর্তে তারা প্রায়শই সবকিছুর দায় প্রতিপক্ষের ওপর চাপিয়ে দেয়। কিন্তু রাজনীতির নিষ্ঠুর নিয়ম হলো, যে দল জনগণের আস্থা হারায়, ইতিহাসে তার কোনো স্থান থাকে না। বিএনপি যদি এখন নিজেদের ভুলগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন না করে, তাহলে তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। জনগণ থেকে দূরত্ব আরো বাড়বে, নেতারা আরো অসহায় হয়ে পড়বেন এবং দলটি ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে।

৩.
বিএনপির এই গভীর সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমূল পুনর্গঠন এবং আত্মসমালোচনা জরুরি। যদি দলটি নিজেদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা ধরে রাখতে চায়, তাহলে কিছু মৌলিক পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। যেমন-

সরাসরি নেতৃত্ব ও তৃণমূলকে ক্ষমতায়ন : 

দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে অবশ্যই সাংগঠনিক শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভার্চুয়াল নেতৃত্ব নয়, বরং তারেক রহমানকে দ্রুত দেশে ফিরে মাঠের বাস্তবতা বুঝে সরাসরি নেতৃত্ব দিতে হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দিতে হবে, যাতে তারা স্থানীয় বাস্তবতা অনুযায়ী কাজ করতে পারেন। এতে তৃণমূল শক্তিশালী হবে এবং দলের সঙ্গে তাদের সরাসরি সংযোগ গড়ে উঠবে। 

যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন : 

মনোনয়ন এবং দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই যোগ্যতা, ত্যাগ এবং জনগণের আস্থা অর্জনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কেন্দ্রীয় নেতাদের খুশি করার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার অর্থে যারা দলের জন্য কাজ করেছেন, তাদের মূল্যায়ন করতে হবে। 

নৈতিকতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা : 

দলের নাম ব্যবহার করে যারা অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো রাজনৈতিক প্রভাবকে প্রশ্রয় না দিয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় দোষীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে দলের প্রতি নতুন করে আস্থা তৈরি হবে।

জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ : 

বিএনপিকে অবশ্যই জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করতে হবে। তাদের দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অভিযোগ শুনতে হবে এবং তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। শুধু নির্বাচনের সময় নয়, বরং বছরের পর বছর ধরে জনগণের স্বার্থে কাজ করতে হবে। 

ট্যাগিংয়ের রাজনীতি বন্ধ করা : 

বিএনপিকে অবশ্যই ট্যাগিংয়ের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। বর্তমান প্রজন্মের পালস বুঝা জরুরি। দায় চাপিয়ে দেয়ার রাজনীতি অন্তত এই সময়টায় আর চলে না। নিজেরা কতটুকু জনগণের কল্যাণে কাজ করেছে, সেটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করতে হবে। এ বিষয়টা যতদ্রুত বুঝতে পারবে, ততই মঙ্গলজনক। 

বিএনপির এই সংকট শুধু তাদের নিজেদের জন্য নয়, বরং দেশের গণতন্ত্রের জন্যও উদ্বেগজনক। তাই, বিএনপি যদি জনগণের আস্থা হারায়, তবে তা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্যও ক্ষতিকর হবে। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা, সততা, ত্যাগ এবং সত্যিকারের রাজনীতিÑ এগুলো ছাড়া বিএনপির টিকে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আত্মসমালোচনা, দলীয় পুনর্গঠন ও দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমে বিএনপি আবারো বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কার্যকর শক্তি হিসেবে ফিরে আসবে, এ প্রত্যাশাই ব্যক্ত করছি।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কেকে/এমএ
আরও সংবাদ   বিষয়:  বিএনপি   সংকট   উত্তরণ   ফাহিম হাসনাত  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

ট্রাক ভাড়া করে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করত তারা
শিশু বলাৎকার ও হত্যার অভিযোগে কিশোর গ্রেফতার
১১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় এক বিলিয়ন ডলার
মুরাদনগরের ওসি জাহিদুরের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বসহ নানা অভিযোগ, অপসারণ দাবি
জিয়া পরিবার জনগণের পরিবার : আমান উল্লাহ

সর্বাধিক পঠিত

চিকিৎসক ও জনবল সংকটে ব্যাহত হচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা
আসছে নাটক ‘অপ্রকাশিত ভালোবাসা’
কালাইয়ে বিএনপির গণমিছিল ও লিফলেট বিতরণ
রাজশাহীতে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস পালিত
ফতুল্লায় ঝগড়া থামাতে গিয়ে প্রাণ গেল যুবকের

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close