দুর্গাপূজার আগমনী বার্তা শিউলি ফুল জানান দিচ্ছে পূজা এসে পড়েছে। শিউলি ফুল ছাড়া শরৎ যেমন নিষ্প্রাণ, তেমনি শারদীয় উৎসবও অনেকটাই অসম্পূর্ণ। কথিত আছে, দেবী দুর্গার সব থেকে পছন্দের ফুল শিউলি। তাই দুর্গাপূজার অঞ্জলিতে শিউলি ফুলের গুরুত্ব অপরিসীম।
শিউলি হচ্ছে নিক্টান্থেস প্রজাতির একটি ফুল। এটি দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে পশ্চিমে বাংলাদেশ, ভারত, উত্তরে নেপাল, ও পূর্বে পাকিস্তান পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যায়। এই ফুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যফুল ও থাইল্যান্ডের কাঞ্চনাবুরি প্রদেশের প্রাদেশিক ফুল। শিউলি গাছের বাকল বা চাল নরম ও ধূসর বর্ণের হয়। এই গাছ ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছের পাতাগুলো ৬-৭ সেন্টিমিটার লম্বা ও সমান্তরাল। পাতাগুলো গাঢ় সবুজ এবং খসখসে হয়। এই ফুলে রয়েছে পাঁচ থেকে সাতটি সাদা বৃত্তি এবং মাঝে লালচে-কমলা টিউবের মতো বৃন্ত। এই কমলা অংশ দিয়ে গ্রামের অনেক শিশু-কিশোর ছবিতে রঙের ছাপ দেয়। অনেকেই আবার মালা গেঁথে পরে। পুতুলের গলাতেও পরিয়ে দেয়া ছাড়াও মেয়েরাও খোঁপায় পরে। ভোর হলেই তারা ছুটে যায় শিউলি তলায়। এর ফল মূলত চ্যাপ্টা ও বাদামি দেখতে হৃৎপিন্ডাকৃতির। ফলের ব্যাস ২ সেন্টিমিটার এবং এটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি ভাগে একটি করে বীজ থাকে।
শিউলি ফুলকে অনেকে শেফালী নামেও ডাকে। এই ফুলের প্রধান বৈশিষ্ট হলো এটি রাতে ফোটে সকালেই ঝরে যায়। রেখে যায় সুগন্ধ আর রেশ। লাল আর হলুদের মিশ্রণ যখন সাদা রঙের ফুলের ভেতর উকি দেয় সূর্যের মতো, তখন সূর্যের মিষ্টি আলোতে ভরে উঠে শিউলী তলা। স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে পুরো সকাল। সবুজ পাতার মধ্যে এক-একটি শিউলী ফুল ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয় সৌন্দর্যের। ফুলের কলিরা তখন আড়মোড়া ভাঙে নতুন দিনের অপেক্ষায়।
শুধু শিশুরা নয় বরং সকল মানুষের পাশাপাশি শিউলী ফুল প্রিয় অনেক মৌমাছি আর অন্যান্য পাখিদেরও। তাইতো তারাও ভিড় জমায় শিউলী তলায়। হিন্দু পুরাণ মতে শিউলি ফুলের আরেক নাম পারিজাত। কথিত আছে, শ্রী কৃষ্ণের স্ত্রী রুক্মিণী ও সত্যভামার বড় ইচ্ছে ছিল তাদের বাগানে স্বর্গের পারিজাত বৃক্ষ বসানোর। স্ত্রীর ইচ্ছা পূরণের জন্য কৃষ্ণ স্বর্গের বাগান থেকে পারিজাত বৃক্ষের একটি শাখা ভেঙ্গে এনে সত্যভামার বাগানে বসিয়ে দেন। গাছ বড় হয়ে ফুল ফোটার পর সেই ফুল রুক্মিনির বাগানেও পড়ে, এই ঘটনাটি ইন্দ্রদেব জানার পর যথারীতি রেগে যান এবং অভিশাপ দেন ওই গাছে ফুল ফুটলেও ফল কোনদিনও হবে না। সেই থেকে পারিজাত ফুলের গাছে তথা শিউলি ফুলের গাছের বীজ থেকে প্রাণ সঞ্চার হয় না|
আরেকটি গল্প থেকে জানা যায়, পারিজাতিকা নামক এক অপূর্ব সুন্দরী নাগরাজকন্যা সূর্যদেবের প্রেমে পড়ে তাকে কামনা করেন। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও ব্যর্থ হওয়াতে তিনি দুঃখে আত্মহত্যা করেন। এরপর তার শরীরের চিতাভস্ম থেকে জন্ম হয় পারিজাত বৃক্ষের। যার ফুল সূর্যের স্পর্শ পাওয়া মাত্রই মাটিতে ঝরে পড়ে অশ্রুবিন্দুর মতো, এক ব্যর্থ প্রেমের প্রতীক হিসেবে। তাই আজও সূর্য ওঠার আগেই ঝরে যায় স্বর্গীয় শোভাধারী শিউলি।
কিন্তু যত গল্পই প্রচলিত থাকুক না কেন এই ফুলের গন্ধ শরতের আগমনী বার্তা বহন করে। এদিকে পূজায় বেল পাতা, শিউলিফুল, ঢাকের কাঠি, ঘণ্টা-কাঁসার আওয়াজ, মঙ্গল শাঁখ ও উলু ধ্বনিতে কেঁপে উঠবে প্রতিটি মন্দির। দেবী দুর্গাকে সবাই মা দুর্গা, পার্বতী, মহামায়া, কৈলাশি, দুর্গতিনাশিনী, পরমা প্রকৃতি, নারায়ণী, মাহেশ্বরী ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেন। মায়ের আগমনে চারদিকে আনন্দ আয়োজন সম্পন্ন করার তাড়া এখন সবার। চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। খুশির আনন্দ ছুঁয়ে যাচ্ছে ঘরে ঘরে, সব বয়সী মানুষের মনে।
বোয়ালমারী উপজেলার ময়না সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কালিপদ চক্র বর্ত্তী বলেন, আমাদের বাড়িতে একটি শিউলি ফুলের গাছ আছে। প্রচুর ফুল ফুটে। প্রতিদিন সকালে উঠে পূজার জন্য শিউলি ফুল কুড়ায়। অন্য পূজারীরা এবং পাশের বাড়ির শিশুরা দল বেঁধে শিউলি ফুল কুড়ায়। এ দৃশ্য দেখতে ভালো লাগে।
কেকে/ আরআই