মানুষের নানা নেশা থাকে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিষ্ণু হাজরা নামে এক চা শ্রমিকের নেশাই বৃক্ষরোপণ। বর্ষার সময়তো বটেই সারাবছরই কমবেশি তিনি বৃক্ষরোপণ করেন। তবে কোনোটিই নিজের জমিতে না, তার রোপিত প্রতিটি বৃক্ষই জনস্বার্থে। কখনো মসজিদ বা মন্দির প্রাঙ্গণে, কখনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কখনো সড়কের দু’পাশ দিয়ে অথবা জলাশয়ের পাড়ে। গাছ লাগানোর পর সেগুলোর পরিচর্যার কাজও তিনি নিজে করেন। কারো জন্মদিন, মৃত্যুবার্ষিকী, বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠানেও বিষ্ণু গাছের চারা উপহার দেন। গত ২৮ বছরে প্রায় ২০ হাজার ফলজ ও ওষুধি বৃক্ষ তিনি রোপণ করেছেন।
প্রকৃতির প্রেমে আকুণ্ঠ নিমজ্জিত মানুষটি ১৯৯৭ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে টিউশনি থেকে পাওয়া সামান্য আয়ে বৃক্ষরোপণ শুরু করেন। প্রথম দিকে রস্তা, ফাঁকা মাঠ ও চা-বাগানের আশপাশে গাছ লাগালেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাজের পরিধি বেড়েছে। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পত্রিকার হকার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে পরিবেশ বিষয়ক নানা প্রতিবেদন পড়ে গাছের প্রতি তাঁর আগ্রহ আরও বাড়ে। ২০২০ সাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি ও ভিডিও পোস্ট করার ফলে স্থানীয় অনেকেই তাঁর সঙ্গে যুক্ত হন। গত ২৮ বছর ধরে বৃক্ষরোপণ করে এখন তিনি সবার কাছে পরিচিত বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর ইউনিয়নের ভাড়াউড়াচা বাগানের বাসিন্দা বিষ্ণু হাজরার নাম এখন বৃক্ষপ্রেমী বিষ্ণু হিসেবে পরিচিত।
স্থানীয়রা জানান, সময় সুযোগ পেলেই নিজের বাইসাইকেলের পেছনে চারা ও গাছ লাগানোর সরঞ্জাম নিয়ে এখানে সেখানে ছোটেন বিষ্ণু হাজরা। রাস্তার ধার, ফাঁকা মাঠ, চা বাগানের আনাচে-কানাচে রোপণ করেন নানা ধরণের গাছ। এতেই তাঁর আনন্দ। এ কাজে নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করতে দ্বিধাবোধ করেন না তিনি। চা শ্রমিক পরিবারে জন্ম নেওয়া মানুষটি দারিদ্র্য উপেক্ষা করে বেছে নিয়েছেন পরিবেশ রক্ষার কাজ। প্রায় ২৮ বছর ধরে এ কাজ করে আসছেন তিনি। পেশায় চা শ্রমিক। চা বাগানে কাজের পাশাপাশি সেখানে ঝালমুড়িও বিক্রি করেন। তাঁর পরিবারে মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই ছেলে সন্তান রয়েছে।
ভাড়াউড়া চা-বাগানের সাবেক সরদার লচমী রবিদাস বলেন, বিষ্ণু মানুষের উপকার করা নিয়েই থাকেন। স্কুলে পড়ার সময় তার বয়সী ছেলেরা যখন খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকত, তখন তিনি গাছ লাগানোর কাজ করতেন। যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হয়, চারা হাতে কোথাও না কোথাও তাঁকে যেতে দেখা যায়।
চা শ্রমিক সুমন হাজরা বলেন, রাস্তার পাশে, শ্মশানের চারপাশ-সবখানেই তিনি গাছ লাগিয়েছেন। তিনি সবসময় বলেন, গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান। এলাকাবাসী বলছেন, নিজের টাকা খরচ করে প্রায়ই বিষ্ণু গাছের চারা রোপণ করেন। গাছ লাগিয়ে তিনি অনেক আনন্দ পান। অনেক অনুষ্ঠানে তিনি গাছ উপহার দেন।
বিষ্ণু হাজরার বাবা প্রেমলাল হাজরা বলেন, আমার ছেলের শখ গাছ লাগানো। যখন শুনি, লোকজন তাকে পরিবেশ রক্ষাকারী বলে প্রশংসা করে তখন গর্ব হয়।
এলাকাকাসী বলেন, বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বিষ্ণু হাজরা ভাড়াউড়া চা বাগানে এক নিঃশব্দ বিপ্লব চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এই কাজ পরিবেশ রক্ষায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়ে থাকবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিষ্ণু হাজরা বলেন, ১৯৯৭ সালে আমি শহরের ভিক্টোরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বৃক্ষ’ কবিতাটি পড়ি। সেই কবিতা থেকে বেশ অনুপ্রণিত হই, গাছের অনেক উপকারিতার কথা জানতে পারি। তখন পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনিও করতাম। একদিন মাথায় এলো যদি কিছু গাছের চারা লাগাই, সেই চারা বড় হলে অনেক টাকায় বেঁচতে পারব, অর্থকষ্ট কমবে। তখন থেকেই টিউশনির টাকার একটি অংশ দিয়ে টুকটাক গাছ লাগানো শুরু করি। এখন গাছ লাগানোর পরিধি আরও বাড়ছে। অনেকেই আমাকে গাছের চারা কিনে দিয়ে সহযোগিতা করছেন। বৃক্ষরোপণে সবসময় আমার পাশে থাকেন সন্তুোষ লোহার ও শান্ত মৃধা দীপক নামে দুইজন। ফেসবুকে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার ছবি-ভিডিও আপলোডের মাধ্যমে অন্যদেরও গাছ লাগানোর জন্য আমি অনুপ্রাণিত করছি। আমি উপার্জনের টাকায় পরিবার চালিয়ে একটি অংশ গাছ লাগানো ও চা শ্রমিকের উন্নয়নে ব্যয় করছি।
বিষ্ণু হাজরা বলেন অবাধে বৃক্ষনিধন, বন-জঙ্গল উজাড়, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপরিকল্পিত ময়লার ভাগাড়, প্লাস্টিক দূষণ, নদী দখল ও দূষণ আমাদের পরিবেশ নষ্ট করছে। এসব রক্ষায় বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, বিষ্ণু হাজরার বৃক্ষপ্রেম নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তিনি প্রমাণ করেছেন সীমিত সাধ্য থাকলেও প্রকৃতি-পরিবেশ সুরক্ষার জন্য ব্যক্তির প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এভাবে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সবাই এগিয়ে আসলে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। বৃক্ষেরোপণে বিষ্ণু হাজরা সহযোগিতা চাইলে আমরা চারা বিতরণের মাধ্যমে তার পাশে থাকবো। জলবায়ু ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন ইউএনও।
কেকে/ আরআই