নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে হঠাৎ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে দেড় শতাধিক রোগী। ভর্তিকৃত রোগীরা সকলেই নাটোর পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। এদের মধ্যে শিশু, বয়স্ক ও নারী রোগীই বেশি। হাসপাতালটিকে পর্যাপ্ত ঔষুধ মজুদ আছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ইতোমধ্যে হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন। ডায়রিয়ার কারণ অনুসন্ধানে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি।
জানা যায়, মঙ্গলবার (২ সেপ্টেম্বর) রাত থেকেই নাটোরে পৌরসভার ২ নম ওয়ার্ডের কাঠালবাড়িয়া, চৌকিরপাড় ও ঝাঁউতলা মহল্লা থেকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকে। বুধবার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালটিতে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় পুরুষ ৬৬ জন, নারী ৫৫ জন ও শিশু ২৬ জন। এসব রোগীর মধ্যে গুরুতর অসুস্থ ১৭ জন। এর পরেও ভর্তি হন বেশ কয়েকজন।
রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ, পৌরসভার সরবরাহ লাইনের পানি পানের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার কারণ জানতে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়। ঘটনা তদন্তে আইসিডিডিআরবির একটি প্রতিনিধি দল নাটোরের উদ্দেশ্য রওনা হয়েছে।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মুক্তাদির আরেফিন বলেন, ‘মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর নাটোর পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ঝাউতলা এলাকার প্রায় ৩০ জন বাসিন্দার কেউ কেউ হঠাৎ ডায়রিয়া, পেটে ব্যাথা ও বমি ভাব অনুভব করেন। প্রাথমিক অবস্থায় তারা স্যালাইন, পেট ব্যাথা কমানোর সহজপ্রাপ্য ওষুধসহ বেশ কয়েক ধরনের ওষুধ সেবন করেন। কিন্ত তাতে কাজ না হওয়ায় মধ্যরাত থেকে সদর হাসপাতালে ভর্তি হতে শুরু করেন। এর পর সকাল থেকে একই ওয়ার্ডের কাঠালবাড়িয়া, চৌকিরপাড়, ঘোড়াগাছা ও ডোমপাড়া এলাকার শতাধিক মানুষ একই সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভর্তি হওয়া রোগীদের মাঝে পানিবাহিত রোগের উপসর্গ আছে। বিষয়টি নিশ্চিতে আইসিডিডিআরবির সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তাদের একটি দল নাটোরের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছেন। তারা পানি পরীক্ষা করে কারণ জানাবে। এছাড়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত স্যালাইন, ওষুধ মজুদ আছে। কোনো সংকট হবে না।’
সবাইকে আতঙ্কিত না হতে অনুরোধ করেন তিনি।
রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, মঙ্গলবার বিকেলের পর পৌরসভার সরবরাহ পানি পানের পর তারা হঠাৎ পেটে ব্যাথা অনুভব করেন। তারপর থেকেই ডায়রিয়া, শরীরের রগ ও পেশিতে টানসহ বিভিন্ন সমস্যা অনুভব করতে থাকেন।
আমেনা খাতুন নামের এক রোগীর স্বজন জানান, তিনি বাবা ও ভাইকে হাসপাতালে এনেছেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর থেকে দুইজনই পেটে তীব্র ব্যাথা অনুভব করছিলেন। সময় বাড়ার সাথে সাথে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করা অবস্থায় তাদের হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়েছে।
রবিউল ইসলাম নামের এক রোগী বলেন, ‘বিকেল থেকে শরীর দুর্বল লাগছিলো। সন্ধ্যায় পানি পানের পর পেট ব্যাথা ও ডায়রিয়া শুরু হয়। রাতে ৭-৮ বার ল্যাট্রিনে গিয়েছি। অবস্থা ভালো না হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি।’
সোহাগ শিকদার নামের ঝাউতলা এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে পানি পানের পর আমার পেট ব্যাথা, ডায়রিয়া ও শরীরের রগ ও পেশিতে টান ধরছে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় ঘরেই চিকিৎসা নিচ্ছি।’
একই এলাকার বাসিন্দা মণি বেগম বলেন, ‘বেশ কিছু দিন হল পৌরসভার পানি আসে ঘোলা ও ময়লাযুক্ত। আমাদের অন্য কোন উপায় নেই। তাই বাধ্য হয়েই এ পানি খেতে হয়।’
সদর হাসপাতালের আরএমও ডা. মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘পানিবাহিত কারণই শুধু নয়, গত তিন দিনের টানা গরমে ডিহাইড্রেশনের কারণেও এমন বিপর্যয় ঘটে থাকতে পারে। আমরা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও নার্সদের ছুটি বাতিল করে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি রোগীদের সুস্থ করতে।’
নাটোর পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল হক বলেন, ‘পৌরসভার সরবরাহ করা পানি একই ধরনের কয়েকটি ট্যাংক থেকে ৯টি ওয়ার্ডের সব এলাকায় সরবরাহ করা হয়। তবে ঘটনা ঘটেছে মাত্র একটি ওয়ার্ডের কিছু এলাকায়। ওই এলাকার সরবরাহ লাইনে কোন ত্রুটির কারণে এ ঘটনা ঘটেছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে আমরা বলেছি। তাদের পরামর্শে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পৌর কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে জনগণের সমস্যা সমাধানে কাজ করবে।’
এদিকে, সদর হাসপাতালে রোগীদের দেখতে যান জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন। এ সময় তিনি ভর্তি রোগীদের খোঁজখবর নেন এবং সুচিকিৎসা নিশ্চিতের আশ্বাস দেন।
আসমা শাহীন বলেন, ‘পানি থেকে সকলের পেটের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করছি। ইতোমধ্যে পানির নমুনা বগুড়ার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। স্যালাইনসহ পর্যাপ্ত উপকরণ মজুদ আছে। রোগীদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। বিষয়টি তাদারকি করতে একটি টিম গঠন করা হয়েছে।’
কেকে/এমএ