উন্নত জীবনের আশায় চার যুবকের স্বপ্ন ছিল ইউরোপে পাড়ি জমানো। তবে প্রতারক চক্রের হাতে পরে সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হল ইরানে গিয়ে। মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত আসতে হলো বাংলাদেশের নিজ জেলা নীলফামারীতে। ইতোমধ্যে খুইয়েছে বাড়ি-ভিটা ও সঞ্চয়ের শেষ সম্বল।
এমন ঘটনা ঘটেছে নীলফামারীর বাসিন্দা সুফিয়ান ইসলাম (৩৮), জাহাঙ্গীর আলম বাদশা (৪৫), ওমর ফারুক (২১) ও আব্দুল মান্নান (৪২) এর সঙ্গে। বিদেশে নেয়ার আগে দরদাম কষাকষির একটি কল রেকর্ড সংবাদকর্মীর হাতে এসেছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এ প্রতারক চক্রের মূল হোতা একই জেলার বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান (৪৫)। শুধু মাহবুবুর রহমান নয় এ প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত তার স্ত্রী আশরাফি আক্তার (৩৫) ও তার মেয়ে মুগ্ধ (২২)। তাদের প্রত্যেকের নামে মামলাও করেছেন ভুক্তভোগী সুফিয়ান ইসলামের স্ত্রী নাছিমা আক্তার। মামলার পর আদালত থেকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হলেও অভিযুক্তরা রয়েছেন ধরা ছোঁয়ার বাহিরে।
অনুসন্ধান ও মামলার আর্জি সূত্রে জানা গেছে, নীলফামারী সদর উপজেলার গাছবাড়ি এলাকার সুফিয়ান ইসলাম একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে ভালো বেতনের চাকরি করতেন। হঠাৎই পরিচিত মাহবুবুর রহমান তাকে স্বপ্ন দেখান ১২ লাখ টাকা দিলেই ইউরোপের দেশ গ্রিসে নিয়ে যাবেন সেখানে মাসিক ২ লাখ টাকা বেতনের চাকরি দিবেন। একই প্রলোভনে সাড়া দেন আরো তিনজন। সদর উপজেলার জাহাঙ্গীর আলম বাদশা, ডোমার উপজেলার ওমর ফারুক ও ডিমলা উপজেলার আব্দুল মান্নান।
প্রত্যেকে উন্নত জীবনের আশায় প্রতারক মাহবুবুর রহমানকে ১২ লাখ টাকা করে প্রদান করেন। কিন্তু গ্রিসের টিকিট না দিয়ে মাহবুবুর জানান, ভিসা নিতে প্রথমে যেতে হবে পাকিস্তান। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে রওয়ান দেন তারা। সেখানে গিয়ে বলা হয়, ইউরোপের ভিসা দেওয়া হবে ইরানে। কিন্তু বাস্তবে মানবপাচার চক্র তাদের নিয়ে যায় আফগানিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে দীর্ঘদিন আটকে রেখে তাদের উপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন।
প্রত্যেক পরিবারের কাছে দাবি করা হয় ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ। মুক্তিপণ না দিলে হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়। উপায়ান্তর না পেয়ে পরিবারের সদস্যরা মাহবুবুর রহমানকে চারজনের মুক্তির জন্য আবারো দেন ৪০ লাখ টাকা। পরে তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হলেও তারা প্রাণ বাঁচাতে আফগানিস্তান থেকে ইরানে পাড়ি জমান। ইরানে বাংলাদেশি দূতাবাসের সহায়তায় চলতি বছরের জুন মাসের ৯ তারিখ দেশে ফেরেন সুফিয়ান ইসলাম। ১১ জুন ইরানের খামেনি এয়ারপোর্ট থেকে বাংলাদেশে ফেরেন ওমর ফারুক ও আব্দুল মান্নান। দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর দেশে ফেরেন গত ২৫ তারিখ দেশে ফেরেন জাহাঙ্গীর আলম বাদশা।
জানতে চাইলে ভুক্তভোগী সুফিয়ান ইসলাম বলেন, ‘আমার কাছ থেকে ধীরে ধীরে ১২ লাখ টাকা নেওয়ার পর প্রথমে আমাদের পাকিস্তান পরে আফগানিস্তান ও ইরানের বর্ডারে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্ডারের কাছে নিয়ে আমাদের এক রুমে ৪ জনকে রাখা হয়। আমাদের প্রতিদিন রুটি খেতে দেয়া হতো। ঠিকমতো পানি দিত না। আমাদের অনেক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের চিত্র পরিবারকে দেখিয়ে ১০ লাখ টাকা চায় মাহবুবের পরিবার। পরে আমাদের চার জনের পরিবার থেকে ৪০ লাখ টাকা দিয়ে আমাদের ছাড়িয়ে আনা হয়। ’
তিনি আরো বলেন, ‘পাকিস্তানে আমরা জেলও খেটেছি। সেখানে আদালতে আমাদের জরিমানাও করা হয়। এখন আমাদের পরিবারে অনেক ঋণ।’
তবে প্রতারক মাহবুবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ মো. আসিফ ইসলাম ও আজিজুল ইসলাম মামলা তুলে নেওয়ার জন্য মুঠোফোনে প্রতিনিয়ত হুমকি প্রদান করছেন বলেও অভিযোগ করেন সুফিয়ান।
আরেক ভুক্তভোগী জাহাঙ্গীর আলম বাদশা বলেন, ‘আমি প্রথমে মাহবুবকে ৩ লক্ষ টাকা দেই, সে বলে আমাদের ভিসা করিয়ে দিবে। এর পর নানা অজুহাত আমার কাছ থেকে ব্যাংক , বিকাশ ও নগদ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ১২ লাখ টাকা নেয়। পরে আমাদের যখন ইরানের বর্ডারে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়, তখন আবার আমার পরিবারের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেয় মাহবুবের পরিবার।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি এখন ঢাকা শহরে ছোট চাকরি করছি গ্রামে অনেক ধার দেনা হয়েছে।’
টেলিফোনে আরেক ভুক্তভোগী ওমর ফারুক বলেন, ‘আমি ঋণে জর্জরিত ভাই এখন আমি বাড়িতে নাই। পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমরা চাই আমাদের টাকাগুলো উদ্ধার করতে। আমি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’
এ বিষয়ে অভিযুক্ত মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোন ও তার বাড়ীতে গিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার খোঁজ মেলেনি। অপরদিকে সুফিয়ানকে মামলা তুলে নেওয়ার হুমকিদাতার সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয় নি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এস আই আহসান বলেন, ‘মামলার তদন্ত কার্যক্রম চলছে। যেহেতু টাকা লেনদেনের একটি বিষয় জড়িত সেহেতু আমরা তদন্তের জন্য ব্যাংকে চিঠি লিখেছি। আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। আসামি ধরার জন্য আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি।’
জানতে চাইলে নীলফামারী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম.আর সাঈদ বলেন, ‘ মানবপাচার মামলাটি বিজ্ঞ আদালতের আদেশে তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করছে। আসামিরা এলাকায় নেই। তাদের গ্রেফতারের চেষ্ঠা অব্যাহত রয়েছে।’
কেকে/ এমএস