২৯ আগস্ট ছিল তার জন্মদিন। তার জন্ম তারিখটি ভারতে জাতীয় ক্রীড়া দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারত সরকারের তৃতীয় সর্বোচ্চ মর্যাদাপূর্ণ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণে ভূষিত হন।
ফুটবলে পেলে, ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যানের সমকক্ষ হিসেবে হকিতে তাকেই গণ্য করা হয়। বল তার হকিস্টিকে এতটাই আটকে যেত যে, প্রতিপক্ষ প্রায়ই সন্দেহ করত যে, সে জাদুর কাঠি নিয়ে খেলছে। এমনকি হল্যান্ডেও চুম্বক সন্দেহে তার হকি স্টিকে ভাঙতে দেখা গেছে। জাপানে তার হকিস্টিকে যেভাবে বল লেগে থাকত, তা দেখেই বলা হতো তার হকিস্টিকে যেন আঠা লেগে থাকত। তার ছন্দোময় হকি খেলায় সকলেই বিস্ময় প্রকাশ করতেন। তার ক্রীড়া নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে জার্মানির রুডলফ হিটলারের মতো একগুঁয়ে সম্রাট তাকে জার্মানির হয়ে খেলার প্রস্তাব দেন। তিনি আর কেউ নন। তিনি এ উপমহাদেশে জন্মগ্রহণকারী একজন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ও হকি খেলোয়ার। নাম ধ্যানচাঁদ। হকির বরপুত্র। অনেকে তাকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ হকি খেলোয়াড়ের তোকমা দিয়েছেন। কেউ বলতেন হকির জাদুকর।
হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ
মেজর ধ্যানচাঁদ (২৯ আগস্ট ১৯০৫- ৩ ডিসেম্বর ১৯৭৯) ছিলেন একজন ভারতীয় হকি খেলোয়াড়। ভারতের পুরুষ জাতীয় ফিল্ড হকি দলের এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক বিশ্ব হকির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ তারকা খেলোয়াড় হিসেবেই গণ্য হন। তিনি এমন ভারতীয় হকি দলের সদস্য ছিলেন যারা পরপর তিনটি (১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের আমস্টারডাম অলিম্পিক, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিক এবং ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের বার্লিন) অলিম্পিকেই বিশ্বজয়ীর জয়মাল্য (স্বর্ণপদক) লাভ করেন।
মেজর ধ্যানচাঁদের জন্ম তৎকালীন আগ্রা বর্তমানের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদের এক রাজপুত ব্রাহ্মণ পরিবারে। তিনি পিতা সামেশ্বর দত্ত সিং ও মাতা শরধা সিং-এর দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। পিতা ও অগ্রজ মূল সিং ছিলেন সৈনিক এবং অনুজ রূপ সিংও ছিলেন ভারতীয় হকি দলের এক খেলোয়াড়। তবে শৈশবে তাদের খেলাধুলার বিশেষ কোনো লক্ষণ ছিল না। হকি খেলায় জন্মগত কোনো প্রতিভাও ছিল না, বরং নিরন্তর অনুশীলন, অধ্যবসায়, সংগ্রাম ও সংকল্পের মধ্য দায়ে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
ধ্যান জানতেন পরিবারের ধারা অনুযায়ী তাকেও সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হবে। তাই সাধারণ শিক্ষা লাভের পর ১৬ বছর বয়সে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লিতে প্রথম ব্রাহ্মণ রেজিমেন্টে তিনি সাধারণ সেপাই হিসাবে যোগ দেন। সে সময় সৈন্যবাহিনীতে প্রথম যে ‘ব্রাহ্মণ রেজিমেন্ট’ গঠিত হয়েছিল তার সুবেদার ছিলেন মেজর বালে তেওয়ারী। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ হকি খেলোয়াড় এবং হকি খেলার উগ্র সমর্থক।
মুখচোরা স্বভাবের নিরীহ প্রকৃতির ধ্যানচাঁদকে তিনি বিশেষ স্নেহ করতেন। সারা দিন কাজের শেষে রাতে চাঁদের আলোয় সুযোগ পেলেই ধ্যান হকি খেলায় মেতে উঠতেন। সেজন্য তার সহকর্মী বন্ধুরা ‘চাঁদ’ বলেই ডাকতেন। পরবর্তীতে ‘ধ্যান’ ধ্যানচাঁদ নামেই পরিচিত হয়ে যান। স্টিকে মাথায় বল নিয়ে এঁকে বেঁকে দৌড়ে বিপক্ষের খেলোয়াড়দের ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আনন্দ পেতেন। এভাবে ধীরে ধীরে সৈন্যদলের মধ্যে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ধ্যানচাঁদ মেজর বালে তিওয়ারির তত্ত্বাবধানে হকি খেলা শুরু করেন। সৈনিকদের আন্তঃবিভাগীয় খেলায় নিজের দলের জন্য বিজয়ীর জয়মাল্য এনে সেনাবিভাগের সবদলের শ্রেষ্ঠ সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসেবে নিজের স্থান নিশ্চিত করেন। এভাবেই তিনি সৈন্যবিভাগে ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ হতে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত খেলেন এবং অচিরেই তিনি বিশ্বের একজন মহান খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে ফৌজি দলের নিউজিল্যান্ড সফর নিশ্চিত হলে তিনি সেই সফরে নির্বাচিত হন। আর সেখান থেকেই ভারতের হকি দলের জয়যাত্রা সূচিত হয়- ধ্যানচাঁদের বিস্ময়কর প্রতিভার কথাও ছড়িয়ে পড়ে। নিউজিল্যান্ড সফর শেষে তিনি সাধারণ ‘সেপাই’ থেকে ‘ল্যান্স নায়েক’ পদে উন্নীত হন।
ভারতীয় দল ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে আমস্টারডামে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসে প্রথমবার অংশগ্রহণ করে। ধ্যানচাঁদও সুযোগ পেয়ে ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ ভারতীয় দলের সঙ্গে রওয়ানা দেন। অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার আগে ভারতীয় দল ইংল্যান্ডে ১১টি খেলায় জয়ী হয় এবং সেখানে ধ্যানচাঁদ বিশেষ সাফল্য পান। তার অনুপম খেলার ছন্দোময় সুষমায় আর বিস্ময়কর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ইংল্যান্ডের জনসাধারণ তাকে হকির জাদুকর ও হিউম্যান ঈল অভিধায় ভূষিত করে।