বর্তমান অনলাইন সাংবাদিকতার একটি বহুল ব্যবহৃত বাক্যাংশ হলো—‘যা জানা গেল’। প্রায় প্রতিটি নিউজ পোর্টালেই এই শব্দ তিনটির বহুল ব্যবহার লক্ষ করা যায়। খবরের শিরোনামে এই ধরনের বাক্য থাকা মানে পাঠককে বোঝানো—এই রিপোর্টের ভেতরে রয়েছে এমন কিছু তথ্য, যা আগে জানা যায়নি, এখন প্রকাশ পেয়েছে। পাঠকের মনে এমন একটি মানসিক প্রলোভন তৈরি করা হয়, যেন এই তথ্য না জানলে তার কিছু একটা অধরা থেকে যাবে। অথচ প্রকৃত সত্য হচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই ধরনের শিরোনামে যেটুকু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, রিপোর্টের ভেতরে তার প্রতিফলন ঘটে না।
শুধু ‘যা জানা গেল’ বলেই নয়, একই শিরোনামের সঙ্গে আমরা প্রায়ই দেখি—‘শেষ পর্যন্ত যা জানা গেল’, ‘জেনে নিন কেন বললেন এমন কথা’—এমন আরো বহু বাক্য, যেগুলোর মধ্যে রহস্য, নাটকীয়তা এবং অতি উৎসাহ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সংবাদ পরিবেশনের প্রথাগত রীতি অনুযায়ী শিরোনাম এমন হওয়া উচিত, যাতে পাঠক রিপোর্ট না পড়েও বুঝতে পারেন, কী ঘটেছে, কোথায় ঘটেছে, কাকে ঘিরে ঘটেছে। সেখানে এই নতুন শিরোনাম রীতি তথ্য গোপন করে পাঠকের কৌতূহলকে পুঁজি করার কৌশল মাত্র। একে বলা হয়—ক্লিকবেইট সাংবাদিকতা।
ক্লিকবেইট সাংবাদিকতা বলতে বোঝানো হয় এমন এক ধরনের কনটেন্ট শৈলী, যেখানে শিরোনাম বা কাভার ইমেজ দিয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় চমকপ্রদ বা অতিরঞ্জিতভাবে, অথচ ভেতরের কনটেন্ট সেই দাবি পূরণ করতে পারে না। বাংলাদেশে ইন্টারনেটভিত্তিক সাংবাদিকতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখন অনেক পোর্টালেই রিপোর্ট লেখার আগে শিরোনাম হয়, এবং সেই শিরোনাম নির্বাচনের একমাত্র উদ্দেশ্য—ক্লিক বাড়ানো, অর্থাৎ পাঠককে লিংকে ঢুকতে বাধ্য করা।
এখানে প্রশ্ন উঠে, এ কি সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য? সাংবাদিকতার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো—সত্য প্রকাশ, যাচাইকৃত তথ্য উপস্থাপন এবং জনস্বার্থে কাজ করা।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সাংবাদিকতা গবেষক বিল কোভাচ এবং টম রোসেনস্টিয়েল তাদের ‘দ্য এলিমেন্টস অব জার্নালিজম’ (The Elements of Journalism) বইয়ে বলেছেন—‘সাংবাদিকতার প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হলো সত্যের অনুসন্ধান করা এবং তা প্রকাশ করা।’ বাংলাদেশের প্রেস কাউন্সিল আইনেও বলা আছে, সংবাদ পরিবেশনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি বা ভিত্তিহীন উপস্থাপন একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু ‘যা জানা গেল’ শিরোনামে প্রায়শই আমরা দেখি রিপোর্টের ভেতরে তথ্য অনুপস্থিত, কিংবা এমনভাবে উপস্থাপিত যে তাতে পাঠক বিভ্রান্ত হন।
এই প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে পাঠকের সংবাদবিমুখতা তৈরি করে। কারণ, যখন একজন পাঠক বারবার একই ধরনের চমকপ্রদ শিরোনামে ক্লিক করে সত্য জানতে চান, কিন্তু সংবাদ পড়ে দেখেন সেখানে নতুন কিছু নেই, তখন তিনি আর পরবর্তীবার সাড়া দেন না। এটি পাঠকের তথ্যের প্রতি আস্থা নষ্ট করে দেয়। একসময় সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এর ফলে সমাজে গুজব, অপপ্রচার এবং অসত্য বার্তার প্রসার ঘটে—যা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।
সাংবাদিকতা একটি পেশা এবং একইসঙ্গে একটি নৈতিক দায়িত্ব। সমাজের দিকনির্দেশক হিসেবে সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব শুধু তথ্য দেওয়া নয়, বরং পাঠককে চিন্তাশীল করে তোলা। অথচ ক্লিকবেইট সাংবাদিকতা পাঠকের আবেগ এবং কৌতূহলকে মূলধন হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে মিডিয়া হয়ে পড়ে কেবল বাজার—যেখানে পণ্য হচ্ছে পাঠকের মনোযোগ, আর দাম হচ্ছে তার বিশ্বাস।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে—দায়টা কার? সম্পাদক, সাংবাদিক, না পাঠকের? বাস্তবতা হলো, এ দায় সবার। পাঠকের যেমন সচেতনতা দরকার, তেমনি সাংবাদিকেরও প্রয়োজন নিজ পেশার প্রতি শ্রদ্ধা, এবং সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা। সম্পাদকদের বুঝতে হবে স্বল্পমেয়াদে ভিউ বাড়ানো গেলেও দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠান দাঁড়ায় পাঠকের আস্থার ওপর।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন সংবাদ পরিবেশনের শিরোনামভিত্তিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা। পাঠকের কাছে সত্য এবং নিরপেক্ষ তথ্য তুলে ধরার পুরোনো রীতিতে ফিরে যেতে হবে।
ক্লিকবেইট নয়, বিশ্বাসবদ্ধ তথ্য হোক আগামী সাংবাদিকতার মূল মন্ত্র। পাঠকের দৃষ্টি ধরে রাখার চেয়ে তার আস্থা ধরে রাখা অনেক বেশি জরুরি।
‘যা জানা গেল—এই বাক্যটি যদি কেবল পাঠককে ঠকানোর নতুন পদ্ধতি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা সাংবাদিকতার জন্য আত্মঘাতী। তথ্য যখন ব্যবসা হয়ে যায়, তখন সংবাদ হারিয়ে ফেলে তার সততা। এখন সময় এসেছে সেই হারানো সত্যকে খুঁজে পাওয়ার।
লেখক : কলামিস্ট ও সাংবাদিক