শ্বাসকষ্ট ও জ্বর নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফের সেন্টমার্টিন দ্বীপের ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনা হয় আট দিন বয়সী শিশু মোহামদ জিসানকে। দ্বীপের একমাত্র ২০ শয্যার হাসপাতালটিতে নেই কোনো চিকিৎসক। তবে শিশুটির লক্ষণ দেখে তাকে দ্রুত টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিতে বলেছিলেন সেখানকার দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য সহকারী শহিদুল ইসলাম। কিন্তু সাগর উত্তাল থাকায় তাকে টেকনাফের হাসপাতালে আনা যায়নি। গুরুতর অসুস্থ শিশুটির মৃত্যু হয় চিকিৎসা না পেয়ে।
বৃহস্পতিবার (২২ মে) সকাল ৯টার দিকে হাসপাতালে মারা যায় জিসান। সে দ্বীপের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ তৈয়বের ছেলে। এ নিয়ে দুই দিনের ব্যবধানে হাসপাতালে নিতে না পারায় দ্বীপে অসুস্থ হয়ে দুই শিশুর মৃত্যু হলো।
মঙ্গলবার (২০ মে) দুপুরের দিকে দ্বীপের গুচ্ছগ্রাম ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. আমিনের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ বেলালের মৃত্যু হয়। সাগর উত্তাল থাকায় মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে সার্ভিস ট্রলার চলাচল বন্ধ ছিল। এর ফলে অসুস্থ রোগীদের টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া যাচ্ছে না। দ্বীপের ২০ শয্যা হাসপাতাল এত দিন চলছিল একজন অফিস সহায়ক দিয়ে। কয়েক দিন আগে একজন স্বাস্থ্য সহকারী নিয়োগ দেওয়া হলেও কোনো চিকিৎসক নেই। সেন্টমার্টিনে হাসপাতাল থাকলেও নেই কোনো চিকিৎসক।
দ্বীপবাসীর দাবি অনুযায়ী এখনো যোগ দেননি চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা। নেই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ও ওষুধ। দ্বীপের জন্য কোনো নৌ অ্যাম্বুলেন্সেরও ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না দ্বীপের ১১ হাজার বাসিন্দা।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সদ্য আসা স্বাস্থ্য সহকারী শহিদুল ইসলাম মুঠোফোনে জানান, আজ আট দিন বয়সী শিশু জিসানের মৃত্যু হয় হাসপাতালে। সম্ভবত তার নিউমোনিয়া হয়েছিল। তাকে টেকনাফ নেওয়ার জন্য বলা হলেও সাগর উত্তাল থাকায় নেওয়া যায়নি। এর আগে বেলাল নামের আরো এক শিশুর মৃত্যু ঘটে। তীব্র জ্বর আর জন্ডিসের লক্ষণ ছিল শিশুটির। হাসপাতালের আনার পরপরই মারা যায় সে।
শিশু জিসানের দাদি হাসিনা বেগম বলেন, জ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিল জিসান। এর মধ্যে সেন্ট মার্টিন হাসপাতালে নিয়ে গেলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য টেকনাফ নিয়ে যেতে বলেন সেখানকার স্বাস্থ্য সহকারী। কিন্তু সার্ভিস ট্রলার চলাচল বন্ধ থাকায় চিকিৎসার জন্য টেকনাফে নেওয়া সম্ভব হয়নি।
পাঁচ বছর বয়সী বেলালের জন্ডিস হয়েছিল বলে ধারণা করছেন বাবা মোহাম্মদ আমিন। তিনি বলেন, সাগর উত্তাল থাকার কারণে সার্ভিস ট্রলার চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে ছেলেটিকে আমরা চিকিৎসাই দিতে পারিনি। আমাদের চোখের সামনেই মারা গেল সে। একটা নৌ অ্যাম্বুলেন্স থাকলে হয়ত ছেলেটা বাঁচত। মঙ্গলবার থেকে গতকাল বিকাল পর্যন্ত তিন দিন আবহাওয়া খারাপ থাকায় টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে সার্ভিস ট্রলার চলাচল বন্ধ ছিল। তবে গতকাল বিকাল ৫টায় আবহাওয়া ভালো হওয়ায় টেকনাফ থেকে যাত্রী ও মালামাল নিয়ে একটি ট্রলার সেন্ট মার্টিনের দিকে রওনা দেয় বলে জানান সার্ভিস ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রশিদ।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম জানান, দ্বীপের বাসিন্দা ও পর্যটকদের কথা বিবেচনা করে ২০০২ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পশ্চিম পাড়ায় প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে একটি হাসপাতাল ভবন নির্মাণ করা হয়। হাসপাতালটি ২০ শয্যার হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে দ্বীপের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা চিকিৎসক প্রণয় রুদ্র জানান, সেন্ট মার্টিন হাসপাতালে শুধু একজন অফিস সহায়ক ছিলেন। একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিশেষ ব্যবস্থায় একজন স্বাস্থ্য সহকারীকে পাঠানো হয়েছে। তিনি এখন দ্বীপের মানুষকে জরুরি চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। জটিল কোনো রোগী হলে টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকদের সঙ্গে টেলিযোগাযোগের মাধ্যমে সেবা প্রদান করে যাচ্ছেন তিনি।
কেকে/এএম