শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতির প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থাহীনতা বহু পুরোনো। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি শব্দটি আজকাল অনেকটাই বিতর্কিত। ছাত্ররাজনীতি মানেই যেন সহিংসতা, মারামারি, দখলবাজি কিংবা দলীয় দাপটের গল্প—এমনটিই গেঁথে গেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে। তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় যখন রাজনৈতিক অঙ্গন হয়ে উঠেছে কাদা ছোড়াছুঁড়ির মাঠ, ঠিক এমন সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) শিক্ষার্থীদের জন্য কল্যাণকর কাজের উদ্যোগ নিয়েছে দুই ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। কিছু মতাদর্শের পার্থক্য থাকলেও যেন শিক্ষার্থীদের জন্য ভালো কাজের প্রতিযোগিতায় নেমেছে দুই সংগঠন। এ প্রতিযোগিতা ব্যানার টানানো বা স্লোগান দেওয়ার নয়; এটি সেবার, মানবিকতার, দায়িত্ববোধের প্রতিযোগিতা।
সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে ছাত্রদল সারাদেশে দফা-২৬ ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য এবং সার্বজনীন চিকিৎসা’ কে সামনে রেখে বিনামূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্প আয়োজন করছে। এরই অংশ হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় এক ব্যতিক্রমধর্মী ক্যাম্প—যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। এই উদ্যোগটি ছাত্ররাজনীতির প্রতি এক নতুন আস্থার জন্ম দেয়।
অন্যদিকে ইসলামী ছাত্রশিবির আয়োজিত ‘আশ শিফা হেলথ ক্যাম্প ২০২৫’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ‘আমি যখন অসুস্থ হই, তিনিই (আল্লাহ) আমাকে আরোগ্য দান করেন’—এই আয়াতকে সামনে রেখে আয়োজিত ক্যাম্পে ডাক্তারের পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করা হয় বিনামূল্যে।যা সম্পূর্ণ শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক উদ্যোগ এব্বনহ প্রাতিষ্ঠানিক অংশীদারিত্বে এক সুসংগঠিত প্রয়াস।
মতাদর্শে ভিন্নতা থাকলেও দুপক্ষই যে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করতে আগ্রহী, এ আয়োজন যেন সেটারই বার্তা দেয়। ক্যাম্পাসের এক পাশে যখন ছাত্রদলের ব্যানার, আর অন্য পাশে শিবিরের ব্যানার—দুটোরই মূল বার্তা এক, ‘আমরা আছি তোমাদের পাশে’। সংগঠন গুলোর এ কাজ শিক্ষার্থী মহলে হচ্ছে বেশ সমাদৃত।
সরেজমিনে দেখা যায় শিক্ষার্থীরা আগ্রহ সহকারে সেবা নিচ্ছে। এমনি সেবা গ্রহণকারী আশরাফুল আলম মাহি নামের ৫০ তম আবর্তনের এক শিক্ষার্থী জানান, ‘রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের এমন উদ্যোগ এর আগে তেমন দেখা যায়নি। বিগত ১৭ বছর ধরে আমরা যে রাজনৈতিক চিত্র দেখে আসছিলাম এটা তার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের উদ্যোগ গুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি এমনটাই হওয়া উচিত। যেখানে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন গুলো শিক্ষার্থীদের সেবায় নিয়োজিত থাকবে।’
এই উদ্যোগগুলো শেখায়—রাজনীতি যদি মানুষের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে সে রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জন্মায়। ভবিষ্যতে যদি সব ছাত্রসংগঠন এভাবে মানবিকতায় একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামে, তাহলে হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ছাত্ররাজনীতি আবারও হয়ে উঠবে গর্বের, আশার আলো ছড়ানোর এক শক্তিশালী মাধ্যম। আর তখনই ‘শিক্ষার্থীদের জন্য রাজনীতি’ নয়, ‘রাজনীতির জন্য শিক্ষার্থীরা’ এই বিপরীত মিথ ভেঙে যাবে। তৈরি হবে এক ইতিবাচক, প্রগতিশীল ও শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতির নতুন ভোর।
শিক্ষার্থীরা যদি দেখতে পায়, রাজনীতি তাদের বাস্তব সমস্যার সমাধানে কাজ করছে—তবে আবারও ফিরে আসবে সেই হারানো আস্থা, তৈরি হবে এক গঠনমূলক এবং শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক রাজনীতির পরিসর। রাজনীতির প্রতিযোগিতা যদি হয় সেবায়, সহানুভূতিতে—তবে এ জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব আরও মানবিক, দূরদর্শী ও দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে নিঃসন্দেহে।
কেকে/ এমএস