কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুর হলো মৃৎশিল্পের গ্রাম। দীর্ঘ সময় ধরে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে বাজারজাতের মাধ্যমে আয়-উপার্জন করছেন এই গ্রামের অনেকেই। বংশপরম্পরায় মাটির জিনিসপত্র তৈরির কাজটা পরম মমতায় করে যাচ্ছেন তারা। প্লাস্টিকের সহজলভ্যতার কারণে মাটির জিনিসের প্রতি তেমন আর আগ্রহ নেই অনেকেরই। তবে নান্দনিক কারুকাজ তৈরি মাটির ক্রোকারিজ, শো-পিস সামগ্রী দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
এত সমস্যা ও সংকটের মধ্যেও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে কুমিল্লার বিজয়পুরের মৃৎশিল্পীদের একমাত্র প্রতিনিধিমূলক সংগঠন ‘রুদ্রপাল সমবায় সমিতি’।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হাত থেকে উদ্ধারের জন্য ষাটের দশকে এ দেশের সমবায় আন্দোলনের পথিকৃৎ ড. আখতার হামিদ খানের অনুপ্রেরণা ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল অনন্য। ১৯৬১ সালে বিজয়পুর গ্রামের প্রগতি যুব সংগঠনটিকে রূপান্তর করে বিজয়পুর রুদ্রপাল সমবায় সমিতি লিমিটেড গঠন করা হয়। শুরুতে ১৫ জন সদস্য নিয়ে সমিতিটি বিজয়পুর এলাকার সাতটি গ্রাম নিয়ে গঠন করা হয়।
প্রায় ৮২ শতক নিজস্ব জায়গায় অবস্থিত এই কারখানা। মৃৎশিল্প উৎপাদনকেন্দ্রে সমিতির সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের মৃৎশিল্পের ওপর নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ মৃৎশিল্পী সৃষ্টি করে যাচ্ছে। বর্তমানে সমিতির সদস্যসংখ্যা বেড়ে ২৫০ জন হয়েছে।
দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের বাজারে জনপ্রিয় হওয়া কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প প্লাস্টিকের সহজলভ্যতা ও গ্যাস-সংকটের কারণে বিলুপ্তি পথে রয়েছে। তবে গ্যাস সরবারহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সনাতনপদ্ধতি খড়-কাঠ দিয়ে মাটির জিনিস পোড়ানো হচ্ছে। এতে লোকবল বেশি লাগছে তাদের। আবার লাকড়ির চুল্লিতে আগুন সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না বলে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ পণ্যই নষ্ট হচ্ছে।
রুদ্রপাল সমবায় সমিতির সভাপতি তাপস কুমার পাল বলেন, শুরুতে আমরা কাঠ, পরবর্তীতে কয়লা, এরপর কারেন্টে পোড়ানোর কাজ করি। ১৯৯২ সাল থেকে গ্যাসের মাধ্যমে আমাদের পণ্য পোড়ানো শুরু হয়। ১৯৯২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক থাকায় প্রচুর বিদেশি অর্ডার পেয়েছি। মাসে ২০ লক্ষাধিক টাকা পণ্য বিদেশে রফতানি করতে পেরেছি।
সমিতির নিজস্ব কারখানায় বিভিন্ন প্রকার রফতানিযোগ্য মৃৎশিল্পসামগ্রী যেমন ঘর সাজানো দ্রব্যাদি, বিভিন্ন প্রকার ফুলদানি, বিভিন্ন প্রকার মডেল, মনীষীদের প্রতিকৃতি, ওয়াল প্লেট, সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক মডেল, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মডেল, জীবজন্তুর মডেল, বিভিন্ন প্রকারের ক্রেস্ট, গারলিক পট, খাবারের প্লেট, বল-বাটি, মগ-জগ, টব ও দধির কাপ,কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতি, ৪০ থেকে ৫০টি আইটেম তৈরি করা হয়। ইত্যাদি তৈরি করা হয়।
এই প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক মানের মৃৎশিল্প পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, যা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে রফতানি কারকদের মাধ্যমে জাপান, কানাডা, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয়।
১৯৮২ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানে মৃৎশিল্পের কাজ করছেন নিমাই চন্দ্র পাল সুপারভাইজার বলেন, এই কারখানা থেকে আমি কাছ শিখেছি। এখানে এখন চাকরি করছি। এখানে যেসব পণ্য উৎপাদিত হয়, সেগুলো বিক্রি করে যে অর্থ আয় হয়, তা থেকে আমাদের বেতন দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে এত কম বেতনে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চার বছর ধরে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এই কারখানায় কাজ করছে প্রতিদিন ৪০০ পাতিল বানাতে হয়। তারপর রৌদে শুকাতে হয়।
সভাপতি তাপস কুমার পাল বলেন, সরকারের সহযোগিতা পেলে মৃৎশিল্প কারখানাটিকে আধুনিক যন্ত্রপাতির সমন্বয়ে যুগোউযোগী করতে চাই। আগের মতো প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি করার ইচ্ছা রয়েছে আবার। শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি শো-রুম করা খুব প্রয়োজন। দেশ-বিদেশ থেকে বরেণ্য ব্যক্তিরা আমাদের প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে করতে আসেন। আমরা একটি মৃৎশিল্প জাদুঘর করব।
বর্তমানে সমিতির পরিচালনায় রয়েছেন মৃৎশিল্প কেন্দ্রে ৭ জন কর্মকতা ও ৫০ জন মৃৎশিল্পকর্মী। যাদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী।
কেকে/এএম