পটুয়াখালীর দুমকিতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার জুলাই আন্দোলনে শহিদ জসিম উদ্দিনের মেয়ে কলেজছাত্রী লামিয়ার (১৭) ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদনে তিন জনের ধর্ষকের আলামত পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে দুজনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হলেও পলাতক রয়েছে মূলহোতা ইমরান মুন্সি (২২)। তবে মামলার এজাহারে নাম নেই ইমরানের।
পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী সার্জন ডা. সায়মা সুলতানা বলেন, ‘ওই কলেজছাত্রীর ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদনে তিন জনের ধর্ষণের আলামত রয়েছে। ভুক্তভোগী ছাত্রী হাসপাতালে আসার দুদিন পর গত ২২ মার্চ মেডিক্যাল প্রতিবেদন পুলিশকে দেওয়া হয়েছে।’
পুলিশ ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই ঢাকার মোহাম্মদপুরে ওই কলেজছাত্রীর বাবা গুলিবিদ্ধ হন। ১০ দিন পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তার শহীদ বাবাকে দুমকি উপজেলার বাড়িতে দাফন করা হয়। ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় বাবার কবর জিয়ারত করে নানাবাড়িতে ফেরার পথে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন কলেজশিক্ষার্থী। ধর্ষণের সময় অভিযুক্তরা তার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিল। এরপর গত ২০ মার্চ দুমকি থানায় ধর্ষণের মামলা করেন কলেজছাত্রী। এজাহারে উপজেলার একটি ইউনিয়নের দুই কিশোরের নাম উল্লেখ করা হয়। মামলা হওয়ার দিন রাতে এজাহারভুক্ত ১৭ বছর বয়সী কিশোরকে গ্রেফতার করা হয়। ২১ মার্চ অপর আসামিকে পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালতের মাধ্যমে তাদের যশোর শিশু সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। এরই মধ্যে ধর্ষণের কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় ওই দুই কিশোর। পাশাপাশি মামলার দিনই পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভুক্তভোগীর ডাক্তারি পরীক্ষা হয়। দুদিন পর ডাক্তারি প্রতিবেদন দুমকি থানায় পাঠানো হয়। প্রতিবেদনে ধর্ষণের ঘটনায় তিন জনের আলামত পাওয়া যায়। ইতোমধ্যে তৃতীয় ব্যক্তিকে শনাক্ত করলেও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুমকি থানার এসআই রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মেডিক্যাল পরীক্ষায় তিন জনের ধর্ষণের আলামত মিলেছে। এর মধ্যে দুই আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। পরে তৃতীয় ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়। কিন্তু এজাহারে তৃতীয় ব্যক্তি ইমরান মুন্সির নাম ছিল না। পরে পলাতক থাকায় তাকে গ্রেফতার করা যায়নি।’
এ ব্যাপারে পটুয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম সজল বলেন, ‘মামলায় দুজনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়। অজ্ঞাতনামা কাউকে আসামি করা হয়নি। এজাহারভুক্ত দুই আসামিকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে যশোর শিশু সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। পরে তাদের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য কিছু দিন আগে পটুয়াখালী কারাগারে আনা হয়েছে। বর্তমানে তারা পটুয়াখালী কারাগারে রয়েছে। ওই দুজনের ডিএনএ পরীক্ষায় ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। তবে পটুয়াখালী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ডাক্তারি পরীক্ষার যে প্রতিবেদন আমাদের দিয়েছে, তাতে তিন জনের ধর্ষণের আলামত মিলেছে। অপর ব্যক্তি হলো কলেজছাত্রীর প্রতিবেশী ইমরান মুন্সি। ঘটনার মূলহোতাও ইমরান। মূলত তার নেতৃত্বেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে তদন্তে নিশ্চিত হয়েছি আমরা। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালাচ্ছি। ঘটনার পর থেকে ইমরান মুন্সি পলাতক।’
এদিকে, ইমরান মুন্সির বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশী খাদিজা বেগম বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে ইমরান পালিয়ে ছিল। গত শনিবার রাতে কলেজছাত্রীর আত্মহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ইমরানের বাবা মালিক মুন্সি, মা রমিজা বেগম এবং ছোট বোন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইমরান মুন্সির দুজন প্রতিবেশী জানিয়েছেন, ধর্ষণের ঘটনায় ইমরানও জড়িত। অথচ মামলায় দুজনকে আসামি করা হয়। ইমরান যদি অপরাধী না হতো তাহলে ঘটনার পর পালিয়ে যেতো না। ছাত্রীর আত্মহত্যার খবর শোনার পর ইমরানের পরিবারও পালিয়ে গেছে। এতে বোঝা যায় ধর্ষণে ইমরানও জড়িত।
মামলার এজাহারে ইমরান মুন্সির নাম না থাকার কারণ জানতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে ঘটনার মূলহোতা ইমরান মুন্সি। তবে এজাহারে তার নাম নেই। ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণে সম্পৃক্ততায় তিন জনের প্রমাণ মিলেছে। ভুক্তভোগীর ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিল অভিযুক্তরা। হয়তো ভয় এবং আতঙ্কে মামলায় ইমরানকে আসামি করা হয়নি। তবে তদন্তে ইমরানের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে।’
এর আগে গত শনিবার রাতে রাজধানীর শেখেরটেক এলাকার বাসা থেকে কলেজছাত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। গলায় ফাঁস নিয়ে ওই ছাত্রী আত্মহত্যা করেন বলে জানায় পুলিশ। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে রোববার বিকালে মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রোববার রাতে সাড়ে ৮টার দিকে বাড়ির আঙিনায় বাবার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়েছে।
কেকে/ এমএস