দেশের প্রাচীন ও প্রথম অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ ২৬ এপ্রিল।
শনিবার (২৬ এপ্রিল) বিকালে দিনটি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি মাহির শাহরিয়ার রেজা এবং সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন শুভ এক বিবৃতিতে দেশব্যাপী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালনের জন্য নেতাকর্মীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’ (তৎকালীন নাম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন)। শিক্ষার অধিকার আদায়ে, সমাজ-প্রগতির লড়াইয়ে, মানুষের জীবন-জীবিকার সংগ্রামে, দেশের মানুষের অধিকার আদায়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন তার জন্মলগ্ন থেকেই সাম্যের আদর্শকে ধারণ করে আপসহীনভাবে রাজপথে লড়ছে।
১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল ভাষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে জন্ম লাভ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম অসম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’ (তৎকালীন নাম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন)। সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ-সাম্রাজ্যবাদ, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, প্রশ্নফাঁস, নিয়োগ-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন সর্বদাই ছিল সোচ্চার।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তার জন্ম থেকেই দেশের মানুষের মুক্তির প্রশ্নে, শিক্ষার অধিকার আদায়ের প্রশ্নে বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছে কিন্তু কখনো আদর্শের প্রশ্নে আপসনামা লেখেনি। সমাজ পরিবর্তনকামী লাখো লাখো স্বপ্নবাজ বিপ্লবীর সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এ দেশের মানুষের মুক্তি-সংগ্রামে, অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তার জন্মলগ্ন থেকেই নিবেদিতপ্রাণ ছিল, আছে।
১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত শরিফ কমিশনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তুলে বৃহৎ ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে তিনজন শহিদ হন। স্বৈরাচারী আইয়ুব খান সরকার বাধ্য হয় শিক্ষাকে পণ্য বানানোর সেই শিক্ষা কমিশন বাতিল করতে। গত শতকের ষাটের দশক ছিল এ দেশের মানুষের মুক্তি-সংগ্রামের দাবিতে উত্তাল সময়। সেই সময়ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তার ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনে পিছপা হয়নি। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রণীত ৬ দফার সঙ্গে ছাত্রসমাজের ৫ দফা দাবিকে যুক্ত করে ১১ দফার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তুলে সর্বদলীয় বৃহৎ ছাত্র আন্দোলন। যেটা পরে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে।
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নায়ক আসাদ ছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। ২০ জানুয়ারি আসাদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ছাত্র জনতা ফুঁসে উঠে শুরু হয় গণঅভ্যুত্থান। সেই অভ্যুত্থানের তোড়ে ভেসে যায় পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকদের গদি। শুরু হয় চূড়ান্ত মুক্তির লড়াই।
১৯৭১ সাল ছিল বাংলার মানুষের মুক্তির বছর। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিস্বরূপ ডামি রাইফেল দিয়ে অস্ত্র চালানো শেখায়। বিভিন্ন শহিদের নামে ব্রিগেড গড়ে তোলে। এসব ব্রিগেডের আওতায় সামরিক কুচকাওয়াজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এর আগে ফেব্রুয়ারি মাসে এক জরুরি কাউন্সিলে ঘোষণাপত্র সংশোধন করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের বদলে নাম পাল্টে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন করা হয়। সে সময়ের কঠিন পরিস্থিতিতে এমন উদ্যোগ ছিল সময়ের সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ।
২৬ মার্চের পর যখন চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তখন এ দেশের মুক্তির সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা আবারও তাদের ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ নিজের জীবন বাজি ধরে গেরিলা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন-ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা বাহিনী ছিল সবচেয়ে বড়। যার সদস্য সংখ্যা ছিল ১০ হাজারেরও বেশি। দীর্ঘ ৯ মাসের সংগ্রামে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন থেমে থাকেনি তার ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২৬ এপ্রিল ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সম্মেলনের শেষ দিন ৫০ হাজার কর্মী নিয়ে ঢাকায় র্যালি বের করা হয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসু নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জয়লাভ করে। কেবল ডাকসু নয়, পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দেশের যেকোনো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ জায়গায় ছাত্র ইউনিয়ন জয় লাভ করেছে। আদর্শিক ছাত্র রাজনীতিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তার জন্মলগ্ন থেকেই শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষ সংগঠন।
কেকে/এএম