কক্সবাজার জেলা শহরের প্রধান নদী বাঁকখালী এখন দখল-দূষণে মৃতপ্রায়। শহরের ময়লা আবর্জনা ফেলে নদীর তলদেশ ভরাট চলছে। নদীর জায়গা দখল ও প্যারাবন ধ্বংস করে গড়ে তোলা হয়েছে কয়েক হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা। আর এই দখল-দূষণ সরেজমিনে দেখে হতবাক সরকারের দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট দুইটি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা।
বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাটসহ বিভিন্ন অংশ সরেজমিনে পরিদর্শনে যান নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘কক্সবাজার থেকে অনুমানিক ১২ হাজার একর বনভূমি উদ্ধার করে বনবিভাগকে দিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা তথাকথিত উন্নয়ন এবং ব্যক্তির স্বার্থে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারের কয়েকটি কাজ আমরা অগ্রাধিকার হিসেবে ধরেছি। কক্সবাজারের ৭শ একটা বন প্রশাসকে, ১৫৫ একর বনের জায়গা নিয়ে একজন ব্যক্তির নামে স্থাপনা হচ্ছে। ২০ একর জমিতে ফুটবল ট্রেনিং সেন্টার হওয়া কথা ছিল। বেজাকে দিয়ে দিয়ে চিংড়ি ঘের করা জায়গা, সব নিয়ে নেওয়া হবে।’
উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘কক্সবাজারের মানুষের অনেক দিনের দাবি বাঁকখালীকে দখল ও দূষণ মুক্ত করা। আগে যখন পরিবেশকর্মী ছিলাম— এসেছিলাম। এখন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে এসেছি। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে দ্রুত সময়ের মধ্যে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে আইনি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, হাইকোর্ট থেকে স্থিতাবস্থা আছে, এসব আইনিভাবে মোকাবেলা করা হবে।’
কস্তুরাঘাটে পৌঁছে দুই উপদেষ্টা বাঁকখালী নদীর সীমানা সংলগ্ন মানচিত্র দেখেন। এসময় কক্সবাজার পৌরসভার ময়লার স্তুপ, দখলে দেখে দুই উপদেষ্টা যান পেশকার পাড়ার অংশে। যেখানে এখনও জোয়ার-ভাটার পানি আছে এবং ট্রলার ভিড়ে এমন স্থান দখলের দৃশ্য দেখে হতবাক হন তারা।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমি বন্দর করব, বাকিরা দখল করবে তা হয় না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হবে। নদীর নির্ধারিত সীমানা রয়েছে, যা গেজেট আকারে আছে। এর মধ্যে যারা দখল করে আছে তাদের সরে যেতে বলা হয়েছে। তা না হলে উচ্ছেদ করা হবে। অনেক বছর ধরে এই দখল প্রক্রিয়া চলছে। নদী বন্দর করতে হলে নদী দরকার। নদীর তীর দ্রুত দখল উচ্ছেদ হবে। সরে যেতে আর সময় দেওয়া হবে না।’
তিনি বলেন, ‘পরিবেশ সংকটাপন্ন ইসিএ এলাকায় কার প্রতিষ্ঠান আছে, তা আমার দেখার বিষয় না। আমার কাজ ইসিএ এলাকায় অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান আছে কিনা তা দেখা। অনুমোদন ছাড়া যার প্রতিষ্ঠান থাকবে তা উচ্ছেদ করা হবে।
এদিকে নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি বাঁকখালী নদী এ জেলার প্রাণ। নদীর পুরোনো চিত্র দেখেছি। বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হলো দখল-দূষণে প্রায় মুমূর্ষু অবস্থা। আমরা নদী বন্দর করবো, আর দখলদারেরা নদীর তীর দখল করে অট্টালিকা বানাবে, এটাতো হতে দেওয়া যায় না। নৌ-মন্ত্রণালয় উচ্ছেদের বিষয়টি দেখবে, আর পরিবেশ মন্ত্রণালয় দেখবে পরিবেশ বিষয়ক ক্ষতিপূরণ। যথা শিগগির এ উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করে বাঁকখালীর প্রাণ রক্ষার চেষ্টা করা হবে। বেলা ১১টার দিকে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন শহরের বদরমোকাম মসজিদ সংলগ্ন বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট পর্যবেক্ষণে আসেন। তারা নবনির্মিত কক্সবাজার-খুরুশকুল ব্রিজ ও আশপাশ এলাকা পরিদর্শন করেন।
পরিবেশবিদদের মতে, প্রায় প্রতিদিনই প্রভাবশালীদের নগ্নথাবায় বাঁকখালীর চরে কোথাও না কোথাও পাকা দালান উঠছে। প্রশাসনের সীমাবদ্ধতার অযুহাত এবং আইনি জটিলতায় বেপরোয়া দখলের প্রতিযোগিতা চলছেই। অনেকটা অভিভাবকহীন জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ নদী। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও শহরের ময়লা-আবর্জনা ফেলে নদীর তলদেশ ভরাট চলছে। নদীর জায়গা দখল ও প্যারাবন ধ্বংস করে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা। মাঝে মাঝে জেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে কিছু স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও পরবর্তীতে তা আবারও তৈরি হয়। একসময় নৌপথে শহরের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র কস্তুরাঘাট এখন সুবিশাল আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে।
বাঁকখালী ও অন্য নদীর তীর দখল বিষয়ে একই দিন বিকেল সাড়ে ৪টায় দুই উপদেষ্টা জেলা প্রশাসন, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, জেলা পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে বৈঠক করার কথা রয়েছে।
বৈঠকে কক্সবাজার নদী বন্দরের অবৈধ দখল-দূষণ রোধ, নদীবন্দরের সীমানা পিলার স্থাপন, ড্রেজিংয়ের বিষয়সহ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে বলে নৌপরিবহন উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত উপদেষ্টার সফরসূচিতে উল্লেখ করা হয়।
অপরদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন ও বিআইডব্লিউটিএ’র ২০২৩-২০২৪ সালের পৃথক প্রতিবেদন বাঁকখালী নদী দখলে জড়িত ১৩১ জনকে চিহ্নিত করেছিল। আজকের বৈঠকে তাদের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত আসে তা নিয়ে কৌতূহল এখন কক্সবাজারের সচেতন মহলে। এরমধ্যে কস্তুরাঘাট সংলগ্ন নির্মিত খুরুস্কুল সেতুর আশপাশ ঘিরে দখলে জড়িত আরও ৫০ জনের মাঝে ২৩ জনের বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলাও করেছে।
এদিকে, বাঁকখালী নদী পরিদর্শন শেষে কক্সবাজার-মহেশখালী নৌপথে চলাচল শুরু করা সী-ট্রাকের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন উপদেষ্টা ড. সাখাওয়াত হোসেন। ৬নং জেটি ঘাট দিয়ে উদ্বোধন করা সী ট্রাকে মহেশখালী যান উপদেষ্টা। সেখানে সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন তিনি।
কেকে/এজে