শ্রীকৃষ্ণদর্শনের প্রাসঙ্গিকতা
পিজুস চন্দ্র দে
🕐 ৫:১৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ১৭, ২০২২
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্রযোগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মধুরায় কংসের কারাগারে মাতা দেবকীর অষ্টম সন্তানরূপে জন্মগ্রহণ করেন। অর্থাৎ ভগবান স্বয়ং চতুর্ভুজ মানুষরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন৷ তাঁর এই আবির্ভাব তিথিকেই জন্মাষ্টমী হিসাবে পৃথিবীব্যাপী উদ্যাপন করা হয়। দুষ্টজনের দমন ও সাধুজনের পৃষ্ঠপোষকতার জন্যই অবতাররূপে তিনি এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
পুরো মহাভারত জুড়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নানান লীলা আমরা প্রত্যক্ষ করি৷ এইসব লীলামৃত আপাতদৃষ্টিতে শিশুতোষ; রূপকথার গল্পের মতো উপাদেয় ও চিত্তাকর্ষক হলেও এর প্রত্যেকটি পৃথক ঘটনা অত্যন্ত অর্থপূর্ণ ও গভীর ইঙ্গিতবহ৷ শ্রীকৃষ্ণের জন্ম-জীবনযাপন-কর্মকাল মাত্র ১২৫ বছরের হলেও এর প্রতীকী তাৎপর্য ব্যপকতায় এতটাই বাঙময় যে এটি সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন-বিধান৷
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে কৌরব ও পাণ্ডব ভাতৃবর্গ যখন মুখোমুখি তখন পাণ্ডবপক্ষের সেরা বীর অর্জুন বিষন্নচিত্তে অস্ত্র ত্যাগ করেছেন; কারণ তিনি স্বজনদের প্রতি কিরূপে অস্ত্র তুলবেন? এমন পরিস্থিতিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কিছু উপদেশ বানীর মাধ্যমে কর্তব্যকর্মে প্রবৃত্ত করেন৷ এইসব উপদেশাবলীই শ্রীমদ্ভাগবতগীতা নামে আমাদের নিত্যদিনের পাঠ্য৷ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রিয় সখা অর্জুনকে নিমিত্ত করে তাঁর প্রিয়তম সৃষ্টি মানুষের প্রতি সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, ন্যায়শাস্ত্র, জীবনবোধ ইত্যাদি বহুবিধ শিক্ষা দিয়েছেন এই গীতার মাধ্যমে৷
যুদ্ধে অনিচ্ছুক বিমর্ষ অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একটি অমোঘ প্রশ্ন করেন, ‘তুমি স্বজন বধ করতে চাওনা; তবে তুমি কাকে মারবে? প্রত্যেক মানুষের দেহ আছে। সেই দেহে আত্মা আছে৷ আর সেই আত্মা অবিনশ্বর৷’ শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মৃত্যুভয় দূর করার জন্য তাঁকে আত্মার অমরত্ব শিক্ষা দেন। শ্রীভগবান বললেন, ‘আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যু নেই; আত্মা অমর। দেহের জন্ম বা মৃত্যু আছে৷ কিন্তু মৃত্যু আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। মৃত্যুতে স্থূল দেহের বিনাশ হয় মাত্র। বস্ত্র পুরাতন হলে যেমন তা পরিত্যাগ করে আমরা নূতন বস্ত্র পরিধান করি, তেমনি আত্মা ভগ্ন ও জীর্ণ দেহ ত্যাগ করে নূতন দেহ গ্রহণ করে মাত্র।’ কৌমার, যৌবন ও জরার মতো মৃত্যুও দেহের একটি অবস্থামাত্র।
প্রিয় সৃষ্টিকে নিজ কর্তব্যকর্মে অবিচল রাখতে তিনি আরও বলেন, ‘হে অর্জুন! তুমি যদি তোমার নিজের ধর্মের কথাও চিন্তা করো, তাহলেও তোমার কম্পিত হওয়া উচিত নয়, কারণ ধর্মযুদ্ধ ছাড়া ক্ষত্রিয়ের অন্য কোনো শ্রেষ্ঠ কাজ নেই।’
লক্ষণীয় যে, ধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি, তিনি মোটেও এখানে তা বোঝাননি। বরং তিনি কর্মকেই ধর্ম বলে ইঙ্গিত করেছেন। তাঁর মতে নিজ নিজ পেশাগত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করাই ধর্ম। অর্থাৎ অধ্যাপকের ধর্ম অধ্যাপনা, ছাত্রের ধর্ম অধ্যয়ন, কৃষকের ধর্ম কৃষিকাজ ইত্যাদি। এই ধর্ম পালনে যে ব্যর্থ হয়, তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। অর্থাৎ, পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবহেলা মানুষের বিপর্যয় ডেকে আনে। ভগবানের এসব উপদেশ হৃদয়ঙ্গম করে অর্জুনের মোহ কেটে যায়। সকল দুর্বলতা পরিত্যাগ করে তিনি যুদ্ধে ব্রতী হন। আর এভাবেই আর্যাবর্তে ধর্মের প্রতিস্থাপন হয়৷
আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পেশাগত শ্রেণিবিভাগ একটি অনস্বীকার্য অনুসঙ্গ। একটি রাষ্ট্র বা সমাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে হলে একে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। শ্রীকৃষ্ণ আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বেই এই শ্রেণিভেদ এর সঠিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন৷ কিন্তু কিছু অবিমৃষ্যকারীর অপব্যাখ্যার ফলে যুগ যুগ ধরে বর্ণপ্রথা হিন্দু সম্প্রদায়ের পরস্পরকে বৈমাত্রেয় করে রেখেছে৷ শ্রীকৃষ্ণ এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘চাতুর্র্বণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ’ গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি চারটি বর্ণ সৃষ্টি করেছি। বর্ণ চারটি হলো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। ব্রাহ্মণের কাজ অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করা, ক্ষত্রিয়ের কাজ যুদ্ধ, রাজ্যশাসন ও দেশরক্ষা, বৈশ্যের কাজ ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকাজ এবং বাকি সব শূদ্রের কাজ। শ্রীকৃষ্ণের মতানুসারে এ গুণগুলোর যেটি যার মধ্যে থাকবে, সে সেই বর্ণের অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ বর্ণ হবে কর্মের ভিত্তিতে, গুণের ভিত্তিতে; জন্মের ভিত্তিতে নয়।
আজকাল প্রায়শই কর্মক্ষেত্রে সেবাপ্রদানকালে নিরপেক্ষতার আহ্বান করা হয়৷ শ্রীকৃষ্ণ বহুপূর্বেই কর্মে অনাসক্তির মাধ্যমে নিরপেক্ষতার উপদেশ করেছেন৷ নিষ্কাম কর্মযোগের মাধ্যমে জীবের মুক্তির পথ প্রদর্শন করেছেন৷ তিনি জানিয়েছেন, অনাসক্তভাবে কর্তব্যকর্ম পালন করলে ভগবদ্দর্শন হয়। ফুল-চন্দন শ্রীভগবানের চরণে অর্পণ করলে যেমন পূজা হয়, তেমনি অনাসক্তভাবে নিজ নিজ কর্তব্যকর্ম পালন করলেও ঈশ্বরেরই উপাসনা হয়। নিষ্কাম কর্মও এক প্রকার ঈশ্বরের আরাধনা।
ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি বা সংঘাত উপমহাদেশের এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিনত হয়েছে আজ৷ অথচ এই উপমহাদেশের মাটিতেই এক অপূর্ব উদারতার বাণী ছড়িয়ে গিয়েছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যা আমরা বেমালুম ভুলে বসে আছি৷ শ্রীগীতার ৪র্থ, ৭ম ও ৯ম অধ্যায়ে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘যিনি যেভাবে আমায় আরাধনা করেন, আমি সেভাবেই তাঁকে কৃপা করি। সকল ধর্মপিপাসু ব্যাক্তি আমারই পথে বিচরণ করছেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘যারা ঈশ্বরের যে রূপ সশ্রদ্ধ চিত্তে অর্চনা করতে চায়, আমি তাদেরকে সে রূপেই অচলা ভক্তি ও বিশ্বাস প্রদান করি।’ এমনকি ‘যারা শ্রদ্ধাযুক্ত মনে অন্য কোনো দেবতার উপাসনা করেন, তারাও অবিধিপূর্বক আমারই উপাসনা করেন।’
জগদীশ্বরের অসংখ্য নাম ও অসংখ্য রূপ। তাঁর যে কোন একটি নামে ও রূপে আমাদের ভক্তি হলেই মুক্তি লাভ সম্ভব। অন্যের ইষ্টদেবতাকে শ্রদ্ধা করা ভগবদ্ভক্তির একটি অন্যতম প্রধান লক্ষণ। গীতায় উল্লেখিত শ্রীকৃষ্ণের এরূপ উদারতা স্পষ্টতই অন্য কোন ধর্মের প্রতি সহিংসতাকে নিরুৎসাহিত করে৷ রুচির ভিন্নতার কারণে সরল কিংবা জটিল যে পথেই মানুষ চলুক না কেন, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা থাকলে সাধকের ঈশ্বরলাভ সুনিশ্চিত।
লেখক : পিজুস চন্দ্র দে, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, বরগুনা