দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলার নাফানগর ইউনিয়নের সেনিহাড়ী গ্রামের সামসুল আলমের স্ত্রী সাবিনা বেগম (৬০)। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ৭ বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখায় ঘুরছেন নিজের কষ্টের টাকার সন্ধানে।
গরুর দুধ বিক্রি ও অন্যের বাড়িতে ঝি-এর কাজ আবার কখনও মাঠে দিনমজুরি হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমে টাকা জমিয়েছিলেন সাবিনা বেগম। ২০০২ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি যোগ দেন গ্রামীণ ব্যাংক নাফানগর ইউনিয়ন শাখার আওতাধীন সেনিহাড়ী ৪০ নম্বর কেন্দ্রের সদস্য হিসেবে। কয়েক বছর পর খুলেছেন ৭ বছর মেয়াদি একটি ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর)। তার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর-৬৬৩৫, জমা-২০ হাজার টাকা। আশা করেছিলেন, মেয়াদ শেষে সেটি হবে ৪০ হাজার। যা নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যেন তার পিছুই ছাড়ছে না। বাড়ি মেরামতের সময় হারিয়ে যায় এফডিআরের রিসিভ কপি। সেই থেকে শুরু হয় তার অনস্ত দৌড়ঝাঁপ। প্রতিদিন ব্যাংকে যান, অনুরোধ করেন তবু কোনো সাড়া মেলে না।
সাবিনা বেগমের কণ্ঠ কাঁপে, চোখের কোনে টলমলে অশ্রুজল নিয়ে বলেন, প্রতিদিন ব্যাংকে যাই। এবং বলি, আমার কাগজ হারিয়ে গেছে। কেউ শোনে না। এক ম্যানেজারকে দুইশ টাকা দিয়েছিলাম চা খাওনের জন্য, যেন খুঁজে দেয় আমার হারানো কাগজ, তাও কিছু হলো না। রাতে ঘুমাইতে পারি না। চোখ বন্ধ করলে ওই টাকার কথাই মনে পড়ে। আমার কষ্টের টাকা, বুকের রক্ত বেচা টাকা।
তিনি আরও বলেন, এই বয়সে আর ঋণ নিতে চাই না, গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য হিসেবেও থাকতে চাই না। কিন্তু উনারা বলেছেন, সদস্যপদ ছাড়লে ফিক্সড ডিপোজিটের টাকাটা পাব না। তাই বাধ্য হয়েই এখনও ব্যাংকের সদস্য হিসেবে আছি। আমি মরার আগে আমার কষ্টের টাকাটা ফেরত পেতে চাই।
বোচাগঞ্জ উপজেলার ১ নম্বর নাফানগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ পারভেজ জানায়, ‘সাবিনা বেগম আমার কাছেও এসেছিলেন। আমি আগের ম্যানেজারকে অনুরোধ করেছিলাম যেন তার টাকা ফেরত দেয়। এটি তার ঘামঝরা উপার্জন করা টাকা। ফেরত না দেওয়া দুঃখজনক।’
গ্রামীণ ব্যাংকের নাফানগর শাখার বর্তমান ম্যানেজার আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। সাবিনা নামে এক বৃদ্ধা এসেছিলেন। তার কাছে রিসিভ কপি নেই। রিসিভ কপি ছাড়া টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে তার একাউন্টে ৬৬৩৫ নম্বরের তথ্য আছে। তিনি থানায় জিডি ও প্রয়োজনীয় কাগজ দিলে বিষয়টি যাচাই করে দেখা হবে। আগে এই শাখা বীরগঞ্জ উপজেলার অধীনে ছিল। পুরনো নথি খুঁজে দেখা হবে।’
সেতাবগঞ্জ সোনালী ব্যাংকের শাখা ম্যানেজার ভূদেব চন্দ্র রায়ের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ক্ষেত্রে সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর চালু থাকলে গ্রহক থানায় জিডি করে ২জন সাক্ষী দিলে টাকা দেওয়া যায়। বিষয়টি খুব জটিল নয়।’
বোচাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মারুফ হাসান বলেন, ‘বিষয়টি মানবিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক শাখার সঙ্গে কথা বলে যথাযথ ব্যবস্থা নেব।’
স্থানীয়রা বলছেন, ‘যে নারী ঘাম ঝরিয়ে টাকা জমিয়েছে, তার প্রাপ্য টাকাটা ফেরত দেওয়া হোক। এটি শুধু অর্থ নয়, তার জীবনের শেষ আশা। আজও সাবিনা বেগম ব্যাংকের দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন। চোখে অশ্রু, মুখে একটাই কথা, আমি মরার আগে আমার কষ্টের জমাকৃত টাকা ফেরৎ পেতে চাই।’
কেকে/বি