বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিভীষিকাময় দিন ১২ নভেম্বর। বিশেষ করে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার জন্য এটি ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী সাইক্লোনের ভয়াল স্মৃতি এবং বেঁচে থাকার এক চলমান সংগ্রামের প্রতীক।
ওই ঝড়ে হাতিয়ায় অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, হাজারো মানুষ নিখোঁজ হয়েছিল। ৫৫ বছর পেরিয়েও স্বজনহারা মানুষের কান্না থামেনি। কিন্তু এতো বছর পরেও দ্বীপের দূর্গম চরাঞ্চলগুলোতে পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে না ওঠায় চরে বসবাসরত কয়েক লাখ মানুষ এখনো ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসের কারনে মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই প্রয়োজনীয় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মানের দাবী জানান চরের বাসিন্দারা।
বঙ্গোপসাগরের বুকে মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত হাতিয়ার চরাঞ্চলগুলো সর্বদা প্রকৃতির তাণ্ডবের শিকার। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঝড়গুলোর অন্যতম।
প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, “১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর দিন ভর ছিলো গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাস। সন্ধ্যার পর মূহুর্তেই ভয়াঙ্কর রুপ ধারন করতে থাকে ঝড়। গভীর রাতে শুরু হয় ঝড়ের তান্ডব। হারিকেনরুপী জলোচ্ছ্বাসের সময় ঝড়টি হাতিয়াসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে। তৎকালীন সময় তথ্যপ্রযুক্তি দুর্বল থাকায় উপকুলের মানুষ ঝড়ের পূর্বভাস পায়নি। এ সময় তিন দিকে নদী ও একদিকে সাগর বেষ্টিত দ্বীপ হাতিয়ায় জলচ্ছাস হয়েছিল ১৫-২০ ফুট উচ্চতায়। রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, খাল-বিল, নদী-নালায় ভাসছিল লাশ আর লাশ। এমনকি গাছের সাথে ঝুলে ছিল শত শত মানুষের মৃতদেহ। বহু মানুষ তাদের প্রিয়জনের লাশ খুঁজেও পায়নি। তখন বাঁচতে কেউ গাছের ডালে, কেউ ঘরের উঁচু চালে আশ্রয় নিয়ে কোনমতে প্রাণে রক্ষা পেলেও ১০দিন পর্যান্ত তাদের প্রায় অভুক্ত কাটাতে হয়েছে।”
৭০-এর বৃদ্ধা নুরবানু বলেন, “তাদের বাড়ি তখন শাহেবানীতে ছিলো। শাশুড়ী ও স্বামী সন্তানসহ আটজনের সংসার ছিলো তাদের। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবে তিনি এক সন্তান অন্যস্থানে গাছের উপর ঝুলে থাকে প্রাণ রক্ষা পায়। কিন্তু হারিয়ে ফেলেছেন পরিবারের সকলকে। আজও কোন সন্ধান পাইনি পরিবারের সদস্যদের। নভেম্বর মাস এলেই মেঘনা নদীর তীরে খুঁজে বেড়াই সেই স্বজনদের।”
নুরবানুর মতো এমন অনেকেই সেই ঝড়ের ভয়াবহতার কথা বলতে গিয়ে আজও শিউরে ওঠেন। প্রলঙ্কারী সেই বিভৎস ঝড়ের তান্ডবের খবর দ্রুত জানতে পারেনি দেশবাসী। ওই সময় বর্তমান সময়ের মতো আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না।
বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর নুর-উন-নবী এমরান বলেন, “তখন ছিল ধান কাটার মৌসুম। চাষা এবং কাজের লোকদের সাথে দ্বীপের প্রায় পুরুষেরা ঢালচর মৌলভীরচর শাহিবানের চরসহ বিভিন্ন চরে গিয়েছিল ধান সংগ্রহের জন্য। সেখানে অস্থায়ীভাবে নির্মাণ করা ঘরে দেড়শো থেকে দুইশ লোক থাকতো। প্রলয়নকারী ঘূর্ণিঝড়ে একসাথে সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এমন অনেক পরিবার রয়েছে যারা তাদের স্বজনদের লাশও খুঁজে পায়নি। গত ৫৫ বছরে যে কয়টি ঘুর্নিঝড় হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ৭০ এর ঝড়টি হিংস্র।”
হাতিয়া উপজেলা কমান্ডার খোন্দকার আবুল কালাম বলেন, “এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রত্যক্ষদর্শী আমার মত অনেকে এখনো বেঁচে আছেন, তারা সেই দিনটিকে মানব ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে স্মরণ করেন। ১২ নভেম্বরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উপকূল দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হলে তাদের সংগ্রাম জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পাবে। এটি সরকারকে এই অঞ্চলের জন্য টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করবে।”
কেকে/ আরআই