নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার একাধিক ইউনিয়ন পরিষদে রোহিঙ্গা নাগরিকদের নামে ভুয়া জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়ার একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ চক্রটি স্থানীয় কিছু অসাধু দালাল, তথ্য সহকারী ও সোনাইমুড়ী বাজারসহ ইউনিয়নগুলোর কম্পিউটার দোকানদারদের সহযোগিতায় দীর্ঘদিন ধরে এই অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষ করে যেসব রোহিঙ্গা নাগরিক বিভিন্ন কারণে কক্সবাজারের আশ্রয় শিবির থেকে পালিয়ে এসেছে কিংবা দেশের বিভিন্ন এলাকায় গা ঢাকা দিয়ে আছে, তারা এই চক্রের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সোনাইমুড়ীর ইউনিয়ন অফিস থেকে জন্মনিবন্ধন সংগ্রহ করছে। যার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশি নাগরিক সেজে পাসপোর্ট, এনআইডি ও অন্যান্য সরকারি সুবিধা পেতে সক্ষম হচ্ছে।
স্থানীয় সচেতন মহলের দাবি, এ ধরনের অবৈধ জন্ম নিবন্ধন দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট ব্যবস্থায় রোহিঙ্গাদের ঢুকে পড়া বড় ধরনের অপরাধ, যার দায় ভার পুরো জাতির ওপর প্রভাব ফেলবে।
কবি ও সাহিত্যিক ফারুক আল ফয়সাল জানান, গত ৩ জুন আমি উপজেলায় একটি জরুরি কাজে যাই। বিকাল তিনটায় দিকে দেখতে পেলাম, সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাচন অফিসে নাম ঠিকানা পরিবর্তন করে জন্ম নিবন্ধন নিয়ে ভোটার হতে এসে রোহিঙ্গা যুবক নুরুল আমিনসহ দুই দালালকে আটক করে নির্বাচন অফিসার। এই ঘটনায় সোনাইমুড়ী থানায় একটি মামলা হয়। মামলা হওয়ার পর বিষয়টি আলোচনায় আসে। তবে এ উপজেলায় জন্ম নিবন্ধন জালিয়াত চক্রের মূল সদস্যরা রয়েছে এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ভুয়া জন্ম নিবন্ধনের তৈরি চক্রের অন্যতম সদস্য সোনাইমুড়ী পৌর এলাকার কৌশল্যারবাগের সাইমন। পাপুয়া গ্রামের আজাদ, ভাওরকোট গ্রামের শফিকুল্লাহ ছেলে বেলায়েত হোসেন, মজিবুল হকের পুত্র সেলিম, কালিকাপুর গ্রামের হুজুর কাউছার, গজারিয়ার মহিন মিয়া। এই দালালদের মাধ্যমে নুরুল আমিন নামে এক রোহিঙ্গা তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ভোটার হওয়ার জন্য সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাচন অফিসে যায়। এ সময় তাকে সোনাইমুড়ী উপজেলার বাসিন্দা বেলায়েত হোসেনকে অগ্নিপতি ও একই গ্রামের সেলিমকে ভাই সাজিয়ে আনা হয়। তাদের কথাবার্তায় সন্দেহ হলে নির্বাচন অফিসার শাহাজাহান মামুন আবেদনপত্রে সই করতে বলেন। তার সই প্রদানে গড়মিল হয়।
নির্বাচন অফিসার তাকে আটক করলে, সে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নিজেকে রোহিঙ্গা নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেয়। পরে নির্বাচন অফিসের মো. ইউসুফ স্ক্যানিং এন্ড ইকুপমেন্ট মেইনটেনেন্স অপারেটর এনআইডি বাদী হয়ে রোহিঙ্গা নাগরিক, নদনা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আজগর হোসেন, জয়াগ ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহিন উদ্দিনসহ ৭ জন দালালকে বিবাদী করে থানা মামলা দায়ের করেন।
এছাড়া একই দালালদের মাধ্যমে গত ২৯ জুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাসরিন আক্তারের সই জাল করে জন্ম নিবন্ধন সৃজন করে। জাল জন্ম সনদ নিয়ে উপজেলা নির্বাচন অফিসে ভোটার হতে আবেদন করে। উপজেলা পাপুয়া গ্রামের ইসরাফিল, আকরাম হোসেন, আব্দুল হান্নান, মাসুম হোসেন ওই জন্ম নিবন্ধন নিয়ে উপজেলা নির্বাচনে অফিসে গেলে কর্মকর্তা শাহাজাহান মামুন ইউএনওর সই সন্দেহ হয়। পরে তিনি ইউএনও নাসরিন আক্তারের কার্যালয়ে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ধৃত যুবকরা স্থানীয় দালাল সাইমন ও আজাদকে প্রতিটি নিবন্ধন ১০ হাজার টাকা করে দিয়ে করেছে বলে জানিয়েছে। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নাসরিন আক্তার তাদের জরিমানা করেন।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশি পরিচয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে রোহিঙ্গারা, আর এ সুযোগে জন্ম নিবন্ধন জালিয়াত চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অঙ্কের টাকা। সোনাইমুড়ী বাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন বাজারগুলোর কম্পিউটার দোকানদাররা এখন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। এসব কম্পিউটার দোকানে টাকা দিলেই ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, জেলা পৌরসভা, উপজেলার বিভিন্ন পৌরসভা, ইউনিয়নের জন্মনিবন্ধন বয়স বাড়িয়ে ও কমিয়ে পাওয়া যাচ্ছে হুবহু অরজিনালের মত জন্ম নিবন্ধন।
কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না সোনাইমুড়ী উপজেলার ইউনিয়নগুলোর জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরিতে অবৈধ চক্রের দৌরাত্ম্য। এ কাজে উপজেলা প্রশাসনের কর্মচারী, সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ও কম্পিউটার দোকানের মালিকরা জড়িত। এ চক্রের সদস্যরা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, যেখানেই বাড়ি হোক- যেকোনো একটি এলাকার নাম দিয়েই বানিয়ে দেবে জন্ম সনদ। প্রতি সনদের জন্য তারা নেয় ৩০-৫০ হাজার টাকা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, কয়েকজন ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, উপজেলার বজরা ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা আব্দুল মতিন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জন্ম নিবন্ধন করে দিচ্ছে। সোনাইমুড়ী বাজারের শাপলা কম্পিউটারসহ বাজারের বেশিরভাগ কম্পিউটার দোকানদার একইভাবে এই অনিমের সাথে জড়িত।
এর সাথে সোনাইমুড়ী পৌরসভার কর্মচারীরাও জন্ম নিবন্ধন জালিয়াত চক্রের সাথে জড়িত হয়ে রোহিঙ্গাদের কাগজপত্র করে দিচ্ছে বলে জানান তারা। এতে করে দীর্ঘদিন থেকে বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই প্রতারক চক্রটি।
সোনাইমুড়ীর নদনা ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আজগর হোসেন বলেন, ‘নাম-ঠিকানা পরিবর্তন করে ও অনলাইন জন্ম নিবন্ধন কম্পিউটার দোকানে এডিটিং করে, অহরহ জন্ম নিবন্ধন তৈরি করছে দালালচক্র। এ সুযোগকে পুঁজি করে, ভুয়া জন্ম নিবন্ধন বানাচ্ছে মোটা অংকের টাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা। এতে করে কে রোহিঙ্গা না স্থানীয় তা বুঝার উপায় নেই। সম্প্রতি এক রোহিঙ্গা যুবক তার ইউনিয়ন পরিষদের ওভার রাইটিং জন্ম নিবন্ধন দিয়ে উপজেলা নির্বাচন অফিসে ভোটার হতে গিয়ে আটক হন। এই ঘটনায় মামলা হলে তাকেও আসামি করা হয়।’
তবে তিনি বিষয়টি অবগত নন বলে জানিয়েছেন।
সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরিন আক্তার বলেন, তার সই জাল করে জন্ম নিবন্ধন তৈরি করে চার যুবক ভোটার হতে এসে আটক হয়। পরে তাদের জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর পরেও বন্ধ হয়নি এসব বেআইনি কার্যক্রম। এগুলোর সাথে উপজেলার সোনাইমুড়ি বাজারের কম্পিউটার দোকানগুলোর মালিকরা জড়িত, আমরা দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব।’
কেকে/ এমএ