রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়েছে অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ। এরইমধ্যে এই রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন দুই জন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন। যদিও এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ। স্থানীয়দের আশঙ্কা, প্রশাসনের পক্ষ থেকে আক্রান্ত পশু জবাই ও মাংস বিক্রি বন্ধ করা না গেলে এই রোগ মহামারীতে রুপ নিতে পারে।
জানা যায়, গত আগস্টে অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গরু জবাইয়ের পর মাংস কাটতে গিয়ে এই রোগে আক্রান্ত হন পীরগাছা সদরের মাইটাল এলাকার কৃষক আব্দুর রাজ্জাক। সব ধরনের চেষ্টার পরও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। আক্রান্তের ৬-৭ দিনের মাথায় রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
মৃত আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী ফেন্সি বেগম বলেন, ‘আগস্টের মাঝামাঝি সময় পাশের বাড়িতে একটি গরু খুব অসুস্থ হয়ে পরলে জবাই করা হয়। পরে আমার স্বামীকে ডাকা হয় মাংস কাটাকাটি জন্য। এ সময় আমার স্বামীর আঙ্গুল অল্প একটু কেটে যায়। ঔ দিন বিকেলে আমার স্বামীর প্রচন্ড জ্বর আসে। পর দিন তার হাতে গোটা গোটা ঘা ওঠে। আস্তে আস্তে এই ঘা শরীরের আরও বহু জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। পরে রংপুর কমিউনিটি মেডিকেলে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা বলেন, পশু থেকে এক ধরনের ভাইরাস তার শরীরে গেছে। ওখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।’
আব্দুর রাজ্জাকের বোন মৌসুমি আক্তার বলেন, ‘প্রথম দিকে জ্বর তারপর ভাইয়ার শরীরে গোটা গোটা এক ধরনের ঘা ওঠা শুরু করে। এরপর শুরু হয় প্রচন্ড শরীর ব্যাথা ও বুক ব্যথা। শরীরের বিভিন্ন জায়গা ফুলে গেছিলো। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ওখানেই মারা যান।
গত শনিবার (৬ সেপ্টেম্বর) উপজেলার আনন্দী ধনিরাম গ্রামের গৃহিণী কমলা বেগমও অসুস্থ গুরুর মাংস রান্না করতে গিয়ে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এখনও এই রোগে ভুগছেন তার পরিবারের আরও তিন সদস্য।
কমলা বেগমের স্বামী জয়নাল আবেদিন বলেন, ‘আমার ভাগিনার দুইটি গরু একসাথে অসুস্থ হয়।
মারা যাবে ভেবে আমরা গরু দুটিকে জবাই করে মাংস ভাগাভাগি করে নেই। আমার স্ত্রী ওই মাংস পরিস্কারের পর রান্না করে। এর দুই দিনের মাথায় তার হাতে ঘা উঠতে শুরু করে। একসময় তা শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। অবস্থার আরও অবনতি হলে আমরা রংপুর মেডিকেলে নিয়ে যাই। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় সে।’
কমলা বেগমের ছেলে দুলাল মিয়া ও তার নাতিসহ এখনো ওই পরিবারের তিনজন এই রোগে আক্রান্ত। তারা সবাই অসুস্থ গরুর মাংস স্পর্শ ও খাওয়ার পরই আক্রান্ত হয়েছেন। এখনও গুরুতর আক্রান্ত হয়ে রংপুর ইসলামিক হাসপাতালে ভর্তি একজন।
দুলাল মিয়া বলেন, ‘আমরা বুঝতে পারিনি অসুস্থ গরুর মাংস নাড়াচাড়া করে বা খাওয়ার পরে এ রকম রোগে আক্রান্ত হবো। ঘাগুলো প্রচন্ড জ্বালাপোড়া করে। আমার মা তো চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারাই গেল। আমি আক্রান্ত, আমার এক বোন আক্রান্ত, আমার নাতি আক্রান্ত হয়ে এখনো হাসপাতালে ভর্তি।’
জানা যায়, গত দুই মাস ধরে পুরো পীরগাছা উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এই ভয়াবহ অ্যানথ্রাক্স। এই রোগে অন্তত শতাধিক মানুষ আক্রান্ত হলেও বেশিরভাগ সুস্থ হয়েছেন। এখনও আক্রান্ত অর্ধশতাধিক মানুষ। আর আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছে প্রায় পাঁচ শতাধিক গবাদি পশু।
পারুল ইউনিয়নের বাসিন্দা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে এভাবে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে একের পর এক গরু মারা গেলেও প্রাণী সম্পদের কেউ আসেনি। গরুগুলো কেন মারা যাচ্ছে, কি সমস্যা আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। এখন বলতেছে এগুলা নাকি অ্যানথ্রাক্স। এই কথা আগে বললে আমরা সচেতন হতে পারতাম। এত গরুও মারা যেত না,এত মানুষও আক্রান্ত হতো না।’
তিনি বলেন, ‘এখনও যদি আক্রান্ত পশু জবাই ও মাংস বিক্রি বন্ধে প্রশাসন কঠোর না হয়, তাহলে এই রোগ মহামারী আকার ধারন করবে।’
একই ইউনিয়নের সেরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমার দুইটা গরু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে একদিনেই মারা গেছে। পরে পাশের বাড়ির একটা গরু ওরকম অসুস্থ হলে আমরা জবাই করে মাংস ভাগ করে নেই। এই মাংস নাড়াচাড়া করে আমি আক্রান্ত। শুধু আমি না যারা যারা ওই মাংস নিয়েছে তাদের বেশিরভাগই এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে।’
আনন্দী ঘনিরামপুর গ্রামের গৃহিনী রাজিয়া বেগম বলেন, ‘আমাদের গ্রামে দুইটা অসুস্থ গরু জবাই করা হয়। পরে গ্রামের মধ্যেই সেই মাংস বিক্রি করা হয়। আমিও এক হাজার টাকা দিয়ে তিন কেজি গরুর মাংস কিনি। এখন সেই মাংস রান্না ও খাওয়ার পর আমার হাতে বড় বড় ঘা উঠেছে। প্রায় এক মাস ধরে ভুগতেছি এখনো ঘা শুকাচ্ছে না।’
রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবু ছাঈদ বলেন, ‘আক্রান্ত পশুর নমুনা পরীক্ষায় অ্যানথ্রাক্স নিশ্চিত হয়েছে। আমরা আক্রান্ত গবাদি পশুর চিকিৎসায় সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন পর্যন্ত পীরগাছা ও আশেপাশের উপজেলায় প্রায় ৩২ হাজার পশুকে অ্যানথ্রাক্সের টিকা দেওয়া হয়েছে। এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’
যদিও এ ব্যাপারে এখনও নির্বিকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। প্রাণী সম্পদ অ্যানথ্রাক্স নিশ্চিত করলেও স্বাস্থ্য বিভাগ মানুষের চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
রংপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. শাহীন সুলতানা বলেন, ‘বিষয় নিয়ে আইইডিসিআরকে জানানো হয়েছে। তবে তারা নমুনা সংগ্রহ করে পাঠাতে বলেছে। কিন্ত এই রোগের নমুনা সংগ্রহ করা অতটাও সহজ নয়। উনাদের উচিত নিজেরা এসে নমুনা সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।’
কেকে/ এমএ