এক বছরের ব্যবধানে আবারও ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী। টানা কয়েকদিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে বৃষ্টিপাতের কারণে জেলার নিম্নাঞ্চলে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। ফলে জেলার অধিকাংশ উপজেলায় বন্যা দেখা দিয়েছে। কখনো টানা আবার কখনো থেমে থেমে ভারি বর্ষণের ফলে বিভিন্ন উপজেলা প্লাবিত হয়েছে। বিশেষ করে জেলার সদর, বেগমগঞ্জ, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলার নিম্নাঞ্চলের সাধারণ মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।
বন্যার ফলে ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে গ্রামীণ রাস্তাঘাট, মাছের ঘের ও পুকুর। জুন ও জুলাই মাসে পরপর দুইবার সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে খাল-বিলগুলো দখল ও দূষণের কারণে পানি অপসারণ সম্ভব না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন স্থানে খালের ওপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও বড় বড় দখলদারদের স্থাপনা এখনো সরানো সম্ভব হয়নি। জেলার বিভিন্ন খালে প্রভাবশালীরা পাকা দালান, রাস্তা, অপরিকল্পিত মাছের ঘের, বেসাল জাল এবং ইরি-বোরো মৌসুমের জন্য তৈরি করা ডুবো বাঁধ নির্মাণ করায় পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতিপথ ব্যাহত হচ্ছে। জেলা পরিষদ ইচ্ছামতো খাল লিজ দেওয়ায় এসব স্থাপনা গড়ে উঠেছে। যার ফলে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নোয়াখালী জেলার প্রধান পানি প্রবাহের খালটি ১৬০০ সালের দিকে খনন করা হলেও বর্তমানে এটি মৃতপ্রায়। নোয়াখালী জেলা সদর থেকে শুরু করে বেগমগঞ্জ, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল ও লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের জন্য খালটি অপরিহার্য হলেও এর অনেক অংশ ভরাট হয়ে গেছে এবং বিভিন্ন স্থানে দোকানপাট ও স্থাপনা গড়ে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, যুগের পর যুগ ধরে গড়ে ওঠা এই দখলদারি পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে স্বল্প সামর্থ্য দিয়ে তা অপসারণ করা সম্ভব নয়।
নোয়াখালী থেকে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ হয়ে ডাকাতিয়া খালে গিয়ে মিশে মেঘনা নদীতে পৌঁছায় এ খাল। খালের এই পথে অসংখ্য ডুবো বাঁধ রয়েছে। বিশেষ করে নোয়াখালী সীমান্তবর্তী নদোনা ইউনিয়নের উত্তরে ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণে রুদ্রপুর গ্রামের কাছে একটি বড় ডুবো বাঁধ পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে।
শুকনো মৌসুমে এই বাঁধের অস্তিত্ব দৃশ্যমান না হলেও বর্ষায় পানির তোড়ে তা উপচে পড়ে। শাকতোলা গ্রামের আবদুল মান্নান (৬০) জানান, প্রায় ১০-১২ বছর আগে ইরি মৌসুমে পানি সেচের জন্য সিমেন্ট দিয়ে তৈরি ব্লক দিয়ে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। তার মতে, এখানে একটি সুইচগেট নির্মাণ করলে ভালো হতো, কিন্তু তা না করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করায় পানির স্বাভাবিক গতি বিঘ্নিত হচ্ছে।
মনোহরগঞ্জ উপজেলার কয়েক কিলোমিটার খালে এমন অসংখ্য ডুবো বাঁধ রয়েছে। এসব বাঁধের কারণে পানি বাধা পেয়ে ধীর গতিতে নামছে।
সোনাপুর ইউনিয়নের আবুল জানান, বেগমগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়ন থেকে নদোনা পর্যন্ত প্রায় ৭-৮ কিলোমিটার খালে অসংখ্য বেসাল জাল দিয়ে পুরো খাল ঘিরে রাখা হয়েছে, ফলে পানির গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। তিনি এসব জাল অপসারণে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
এ ছাড়া খালের কুমিল্লা অংশেও পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সেখানে বন্যা দেখা দিয়েছে। ফলে দুই জেলার সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা অভিযোগ করে বলেন, গত ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে অতিবৃষ্টির কারণে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা হয়। প্রায় তিন মাস স্থায়ী এই বন্যায় জেলার ৭০ শতাংশ অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যায়।
এ সময় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয় এবং বহু মানুষ সেখানে আশ্রয় নেয়। বন্যায় প্রায় ১১ থেকে ১৫ জনের মৃত্যু ঘটে। পানিতে তলিয়ে যাওয়া বাড়িঘর ও গোরস্থান মানুষকে চরম দুর্ভোগে ফেলে। এমনকি মৃতদের কফিনে ভরে কোমর সমান পানির নিচে দাফন করতে হয়।
বন্যা-পরবর্তী সময়ে ক্ষয়ক্ষতির নিরূপণ হলেও ভবিষ্যতের জন্য কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে এক বছরের মধ্যেই আবারও বাসিন্দারা আগের মতো ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন।
বর্তমানে যে অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা হচ্ছে, তা যদি কয়েক মাস আগেই করা হতো, তাহলে এমন ক্ষয়ক্ষতি হয়তো হতো না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডকে খাল পুনঃখননের জন্য ৩২৪ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে খননে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। খালের গভীরতা বাড়ানোর পরিবর্তে নামমাত্র খনন করে টাকাপাচার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
খালের বাঁধ অপসারণের বিষয়ে কথা বলার জন্য নোয়াখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হালিম সালেহীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি।
উপসহকারী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বাবুল খোলাকাগজকে জানান, বন্যা থেকে জেলা রক্ষায় আমরা সোনাইমুড়ী, বেগমগঞ্জসহ জেলার সব উপজেলায় খালের ওপর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অব্যাহত রেখেছি।
সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসরিন আক্তার খোলাকাগজকে বলেন, যে সকল বাঁধ এর কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, আমরা সে সকল বাঁধ অপসারণ করছি, এরোই সাথে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ওয়ার্ড গুলোতে অবৈধ স্থাপনা, উচ্ছেদ অভিযান চলমান রেখেছি। এসময় জলাবদ্ধতা নিরসন ও উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে সোনাইমুড়ী সহকারী কমিশনার (ভুমি), দ্বীন আল জান্নাত সহ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি টিম উপস্থিত ছিলেন।
কেকে/এএম