সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টিকারী মাগুরার চাঞ্চল্যকর শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যাকান্ডের ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিতে নানা অপকৌশল নিচ্ছে ওই মামলার প্রধান আসামি ধূর্ত হিটু শেখ ও তার পরিবার। ইতোমধ্যে এজলাসে তোলার পথে আদালত প্রাঙ্গণে আসিয়ার বড় বোন হামিদা ও আকাশ নামে একজনকে জড়িয়ে হিটু শেখের বক্তব্য ভাইরাল হয়েছে। যদিও আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে তিনি নিজের অপকর্মের কথা স্বীকার করেন। ইতিমধ্যে ডিএনএটেস্টেও হিটু শেখের অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে তদন্তকারীরা। এ অবস্থায় অভিযুক্তদের যেকোনো ধরনের অপচেস্টায় বিভ্রান্ত না হয়ে দ্রুত আইনগত ভাবে আসামি হিটু শেখসহ সংশ্লিষ্ট সকলের উপযুক্ত শাস্তি দাবী করেছেন এলাকাবাসী।
মঙ্গলবার (৬ মে) মাগুরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে আসামিদের সশরীর উপস্থিতিতে দ্বিতীয় সপ্তাহে গুরুত্বপূর্ণ ২ সাক্ষীর সাক্ষ্য হওয়ার কথা থাকলেও সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। তবে দ্রুত সাক্ষ্য গ্রহণ ও আইনি কার্যক্রম শেষে আগামী সপ্তাহেই লোমহর্ষক এ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের মামলার রায় হতে পারে বলে ইতোমধ্যে আশা প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্র পক্ষের প্রধান আইনজীবী।
এ প্রসঙ্গে মাগুরা জেলা জজ আদালতের ইন্সপেক্টর মো. হুমায়ুন কবির বলেন, আসামিদের হাজতখানা থেকে কোর্টে তোলার পথে আনঅফিসিয়াল কোন কথার দায় তারা নিবেন না।
এখনো শুকায়নি মায়ের চোখের পানিঃ
সারেজমিনে নিহত আছিয়ার গ্রামের বাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার জারিয়া গ্রামে গিয়ে কথা হয় তার মা ও মামলার বাদী আয়েশা আক্তারের সাথে। কান্না জড়িত কন্ঠে তিনি এই প্রতিবেদককে ক্ষোভের সঙ্গে জানান, কিছু সাংবাদিক ধূর্ত হিটু শেখের নিজেকে বাঁচাতে মনগড়া বক্তব্য প্রচার করে মামলাটিকে নষ্ট করছে। আসিয়ার বড় বোন হামিদা অত্যন্ত সহজ সরল। তাকেসহ জনৈক আকাশ নামে এক যুবককে জড়ানোর চেষ্টা নিতান্তই অপকৌশল বলে দাবি করেন তিনি। আকাশ নামে কোন মানুষের সঙ্গে তার মেয়ের পরিচয়ও নেই। মাগুরার জেলা প্রশাসক মহোদয়ের পরামর্শে হামিদাকে স্থানীয় জারিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে হামিদা কোন বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
চলছে আছিয়ার প্রথম সাময়িক পরীক্ষাঃ
জারিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলছে। বেঁচে থাকলে অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে আজ এ বিদ্যালয়ে ৩য় শ্রেণীর পরীক্ষায় অংশ নিত শিশু আছিয়া। তার সহপাঠী সামিয়া খাতুন ও অন্বেষা বিশ্বাস জানায়, ‘ক্লাসে আসিয়ার ক্রমিক নম্বর ছিল চার। লেখাপড়ায় সে বেশ ভালো ছিল। তারা সবাই একসঙ্গে আনন্দ করে স্কুলে আসতো। আজ আছিয়া নেই তাদের পরীক্ষা দিতে মন বসছে না।’
বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুপালি বিশ্বাস জানান, ‘আছিয়া ক্লাসে অত্যন্ত মনোযোগী ছাত্রী ছিল। বাড়িতে লেখাপড়ার তেমন পরিবেশ না থাকায় শিক্ষকরা স্কুলেই তার পড়া সম্পন্ন করে দিত। ভালো ছাত্রী হওয়ায় স্কুলের সকল শিক্ষকই তাকে খুব ভালোবাসতো।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সবিতা রানী জানান, ‘দারিদ্র থাকলেও আছিয়া ও তার বোন হামিদা বেশ ভালো ছাত্রী ছিল। তিনি আছিয়া হত্যাকাণ্ডের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।’
আছিয়া হত্যায় ক্ষোভে ফুসছে পুরো গ্রামবাসীঃ
শ্রীপুরের জারিয়া গ্রামের আবাল বৃদ্ধ বনিতা সবার মুখে একই প্রশ্ন- কবে হবে আসিয়া হত্যার বিচার? ওই গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইমদাদুল, কৃষক বিপুল বিশ্বাস, ভ্যান চালক মো. তিনু মন্ডল গৃহবধূ ঠেকারী ঘোষসহ অধিকাংশ গ্রামবাসী জানান, আসিয়ার বাবা ফেরদৌস শেখসহ পুরো পরিবারটিই অত্যন্ত নিরীহ ও শান্তি প্রিয়। ফেরদৌস শেখের হঠাৎ অসুস্থতার কারণে অনেকটা বাধ্য হয়েই বড় মেয়ে হামিদাকে তারা বিয়ে দিয়েছিলেন মাগুরার নিজনান্দুয়ালী গ্রামের হিটু শেখের ছেলে সজিব শেখের সাথে। কিন্তু বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই এতবড় বিপদ তাদের মাথার উপর পড়বে এটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। তারা দ্রুত হিটু শেখ সহ তার পরিবারের সকল অপরাধীর উপযুক্ত বিচার দাবি করেন।
যা বলছে হিটু শেখের এলাকার মানুষঃ
এদিকে গত ১৩ই মার্চ ঢাকা সিএমএইচে আছিয়ার মৃত্যুর খবরে মাগুরা সদরের নিজনান্দুয়ালী গ্রামে হিটু শেখের বাড়ি ভেঙে ও আগুন দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। এলাকাবাসীর মুখে মুখে ফেরে লম্পট হিটু শেখের বিভিন্ন লামপট্যের কাহিনী। ওই গ্রামের মিন্টু মিয়া, রাজীব বিশ্বাসসহ একাধিক এলাকাবাসী জানান, নান্দুয়ালী গ্রামের শেখ পাড়ায় হিটু শেখের পৈত্রিক বাড়ি ছিল। প্রায় ৩০ বছর আগে সেখান থেকে বিভিন্ন অপকর্মের ফলে উচ্ছেদ হয়ে তাকে চলে আসতে হয় একই গ্রামের ঈদগাহ পাড়ায়। সেখান থেকেও এলাকাবাসীর তোপের মুখে ১৫ বছর আগে মাঠের মধ্যে গিয়ে বাড়ি করতে বাধ্য হয় হিটু শেখ। বিভিন্ন নারী ঘটিত কেলেঙ্কারির জন্য ইতোপূর্বেও হিটু শেখ কে জরিমানা ও শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে গ্রামবাসীর কাছে। এবার তার পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেছে। শাস্তি তার হতেই হবে।
গত ১৩ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আলাউদ্দিন রাত ১০টার দিকে জেলার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আব্দুল মতিনের আদালতে মামলার চার্জশিট জমা দেন। চার্জশিটে মামলার ৪ আসামিকেই অভিযুক্ত করা হয়।
অভিযোগে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি হিটু শেখকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও নিহত শিশুর বোন জামাই সজিব শেখ ও তার (সজিব) ভাই রাতুল শেখকে খুন জখমের ভয়-ভীতি প্রদর্শন এবং বোনের শাশুড়ি জাহেদা বেগমকে তথ্য গোপনের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। গত ১ মার্চ শনিবার মাগুরা সদরের নিজনান্দুয়ালী গ্রামে বোনের শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে যায় ভুক্তভোগী শিশু আছিয়া। ৫ মার্চ বুধবার রাতে বোনের শ্বশুর হিটু শেখ ওই শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যার চেষ্টা করে। সকালে প্রথমে মাগুরা সদর হাসপাতাল সেখান থেকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় শিশু আসিয়া। এ সময় আসিয়ার ধর্ষণকাণ্ডের প্রতিবাদে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। সারাদেশে ‘তুমি কে আমি কে আফিয়া আফিয়া’ এই স্লোগানে ধর্ষকদের দ্রুত বিচারের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে। এসময় আছিয়ার চিকিৎসা ও তার পরিবারের ব্যায় ভার বহনের দায়িত্ব নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। জনাব তারেক রহমানের পক্ষে আসিয়ার চিকিৎসার সার্বিক তদারকি করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম নয়ন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসিয়ার শরীরের অবস্থার অবনতি হলে আছিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিসাধীন অবস্থায় ১৩ মার্চ বৃহস্পতিবারে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ওই শিশু মারা যায়। ওইদিনই তার লাশ একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে মাগুরায় আনা হয়। এ সময় ঢাকা থেকে জাতীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ আছিয়ার লাশের সঙ্গে মাগুরায় আসেন। এর আগে ৮ মার্চ নিহত আছিয়ার মা আয়েশা আক্তার বাদী হয়ে ৪ জনের নামে মাগুরা সদর থানায় মামলা দায়ের করেন। এ মামলার উপযুক্ত বিচারের দাবি করে আসছেন জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন নারী ও শিশু অধিকার সংগঠনসহ সচেতন মহল।
কেকে/ এমএস