ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ | ১১ শ্রাবণ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের অগ্রদূত নভেরা

খোলা কাগজ ডেস্ক
🕐 ১:০৮ অপরাহ্ণ, মার্চ ০২, ২০২২

আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের অগ্রদূত নভেরা

নভেরা আহমেদ। একজন বাংলাদেশী ভাস্কর। বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যশিল্পের অন্যতম অগ্রদূত তিনি। বিংশ শতাব্দীর প্রথম বাংলাদেশী আধুনিক ভাস্কর। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক প্রদান করেছেন। তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৪৫ বছর প্যারিসে বসবাস করেন। ষাটের দশকের পিছিয়ে পড়া সময়ে অযুত বাধাবিপত্তি ডিঙিয়ে তিনি একজন ভাস্কর মহিলা হয়েছিলেন। সোনালি ফসল ফলিয়ে গেছেন এককভাবে। তার অপার ক্ষমতা, শিল্পবোধ, শিল্পের প্রতি একনিষ্ঠ তন্ময়তা ও ভালোবাসা, অনুভূতি ও নান্দনিকতা তাকে করেছে ভাস্কর্যের ভুবনে অনন্য। আধুনিক এ ভাস্কর্যশিল্পীকে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন নুরে রোকসানা সুমি

প্রাথমিক জীবন

নভেরা আহমেদ ফ্লোরেন্স। ২৯মার্চ ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের সুন্দরবনে তার জন্ম। চাচা নাম রাখেন নভেরা। ফার্সি শব্দ ‘নভেরা’র অর্থ নবাগত, নতুন জন্ম। কর্মসূত্রে তার বাবা সৈয়দ আহমেদ কর্মরত ছিলেন সুন্দরবন অঞ্চলে। তবে পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের আসকারদিঘির উত্তর পাড়। পরবর্তীতে তার বাবা চাকরিসূত্রে কিছুকাল কলকাতায় অবস্থার করায় নভেরার শৈশব কেটেছে কলকাতা শহরে। বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তিনি নাচ, গান শেখার পাশাপাশি মাটি দিয়ে মূর্তি তৈরি (মডেলিং) করতেন। তিনি কলকাতার লরেটা স্কুল থেকে প্রবেশিকা (ম্যাট্রিক) পাস করেন।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারত বিভাগের পর তারা পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) কুমিল্লায় চলে আসেন। এ সময় নভেরা কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। পিতার অবসরগ্রহণের পর তাদের পরিবার আদি নিবাস চট্টগ্রামে গিয়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করে। এরপর চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন তিনি। পরবর্তী আইন শিক্ষার জন্য তাকে বাড়ি থেকে লন্ডনে পাঠানো হয় ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে। তবে শৈশব থেকেই নভেরার ইচ্ছা ছিল ভাস্কর্য করার; তাই তিনি সেখানে সিটি অ্যান্ড গিল্ডস্টোন কার্ভিং ক্লাসে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে ভর্তি হন ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে ন্যাশনাল ডিপ্লোমা ইন ডিজাইনের মডেলিং ও স্কাল্পচার কোর্সে। সেখান পাঁচ বছর মেয়াদের ডিপ্লোমা কোর্স করার পর ১৯৫৫ সালে তিনি ইতালির ফ্লোরেন্স ও ভেনিসে ভাস্কর্য বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন।

কর্মজীবন
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে নভেরা আহমেদ ফ্লোরেন্সে গমন করেন। সঙ্গে ছিলেন শিল্পী হামিদুর রহমান। প্রথমে তারা শিল্পী আমিনুল ইসলামের আতিথ্য গ্রহণ করেন এবং পরে তিনজন একত্রে একটি স্টুডিওতে উঠে যান। নভেরা প্রায় দুই মাস শুধু ঘুরে দেখলেন। ডক্টর ফোগেল ভেন্তুরিনো ভেন্তুরির নামে এক ইতালীয় শিল্পীর কাছে নভেরার পরিচিতি দিয়ে করে একটি চিঠি দিয়ে দিয়েছিলেন। এই শিল্পীর সাহচর্যে নভেরা দোনাতেলোসহ প্রাচীন কয়েকজন শিল্পীর কাজের সঙ্গে পরিচিত হন এবং দু’মাস তার কাছে কাজ শেখেন। অতঃপর ফ্লোরেন্স থেকে ভেনিসে গেলেন নভেরা ও হামিদ এবং পরবর্কালে ভেনিস থেকে লন্ডন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দেই ক্রিসমাসের ছুটিতে নভেরা ও হামিদ প্যারিসে রঁদার মিউজিয়াম দেখতে গিয়েছিলেন। ভাস্কর্যের ছাত্রী স্বভাবতই অত্যন্ত অভিভূত হয়েছিলেন রঁদার কাজ দেখে।

ব্যক্তিগত জীবন
স্থায়ীভাবে চট্টগ্রামে বসবাস করার সময় এক পুলিশ অফিসারের সাথে নভেরার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। প্যারিসে অবস্থান কালে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে পঁয়তাল্লিশ বৎসর বয়সে তিনি গ্রেগরি দ্য বুনস বিয়ে করেন। ২০১৫-এ মৃত্যু অবধি এই দম্পতি এক সঙ্গেই ছিলেন।

কাজের স্টাইল
একজন ভাস্কর্য্য শিল্পী হিসেবে নভেরা আহমেদের মূল প্রবণতা ফিগারেটিভ এক্সপ্রেশন। তার কাজের প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে নারী প্রতিমূর্তি। তবে নারী প্রতিমূর্তি নির্মাণে তিনি বিমূর্ততার দিকে ঝুঁকেছেন। কাজের স্টাইলের দিক থেকে তিনি ব্রিটিশ ভাস্কর হেনরী মূর (১৮৯৮ - ১৯৮৬ খ্রি.) অনুবর্তী। পরবর্তী কালে আরও একজন ভাস্কর একইভাবে হেনরী মূর দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়েছেন তিনি হলেন জুলিয়া কেইক। নভেরা আহমেদ এবং জুলিয়া কেইক-এর কাজের মধ্যে আশ্চর্যজনক সমিলতা রয়েছে। সমসাময়িক পুরুষ শিল্পীরা ইউরোপীয় ইন্দ্রিয় সুখাবহ নারীদেহে একটি রোমান্টিক ইমেজ দেবার চেষ্ট করেন। এমনকি জয়নুল, কামরুলরা নারীকে মাতা, কন্যা, স্ত্রী এবং অনুভূতিসম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখালেও নারীদের যথার্থ কর্মময় জীবন উহ্যই ছিল। নভেরা আহমেদ নারীকে দেখেছেন সম্পূর্ণ ভিন্নরূপে, পুরুষ শিল্পীদের উপস্থাপনার বিপরীতে। তার কাজে নর-নারীর গ্রন্থনা একটি ঐক্য গঠন করে। তিনি ভাসা ভাসা সুন্দর আনন্দময়ী আদর্শ ফর্ম করার পরিবর্তে তার ফর্মগুলোকে সরল, অর্থপূর্ণ, স্বকীয়তায় সমৃদ্ধ করেছেন। উন্মোচন করেছেন সবধরনের বিচলিত, আবেগমথিত, সত্যিকারের নারীর রূপকে। দি লং ওয়েট কাজটি তারই নমুনা। তার মায়েরা সুন্দরী নয়, কিন্তু শক্তিময়ী, জোড়ালো ও সংগ্রামী। তারা মানবিকতার ধ্রুপদী প্রতীক।

নভেরা তার শিল্পকর্মে একঘেয়েমি কাটাতে পরবর্তীতে কতগুলো কাজে ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছিলেন। যেমন: নগ্ন নারী মূর্তি, লম্বা গ্রীবা ও মাথার এনাটমিতে বাংলাদেশের ‘কন্যা-পুতুলের’ আঙ্গিকের পাশাপাশি হাত-পা-শরীরের অবস্থান স্থাপনের ক্ষেত্রে মদীয়ানির ফর্ম ও ড্রইভের সুষমা, স্তন ও শরীরের উপস্থাপনায় মহেঞ্জোদারোর ‘বালিকা-মূর্তির’ প্রাচ্য অভিলাষকে একত্রিত করেছেন। অন্যদিকে প্লাস্টার অব প্যারিসে নির্মিত দুটি ভাস্কর্যে মুখমন্ডল বহুলাংশে বাস্তবধর্মী, সামান্য গান্ধারা শিল্পধারায় প্রভাবিত। সম্ভবত এই মস্তক দুটি বুদ্ধের মস্তকের অনুকরণে অণুকৃতি।

নভেরার বেশকিছু ভাস্কর্যে আবহমান বাংলার লোকজ আঙ্গিকের আভাস পাওয়া যায়। তবে লোকজ ফর্মের সাথে সেখানে পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়ও বর্তমান। লোকজ টেপা পুতুলের ফর্মকে সরলীকৃত করে তাকে দক্ষতার সাথে বিশেষায়িত করেছেন তিনি। এভাবে ঐতিহ্যের সাথে পাশ্চাত্য শিক্ষার স্বার্থক ভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা তার আধুনিক চিন্তার লক্ষণ। এক্ষেত্রে তার ভাস্কর্যগুলো আদলে তিনকোনা, চোখ ছিদ্র, লম্বা গ্রীবা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে আসে।

১৯৫৮তে সম্পন্ন পরিবার নামীয় কাজটিতে নভেরা গ্রামীণ একটি বিষয় ব্যবহার করেছেন। এখানে মানুষ ও গরুর পা এবং শরীর একীভূত হয়ে গেছে, এভাবেই গরুর ও মানুষ উভয়ের ওপর উভয়ের নির্ভরশীলতা বোঝানো হয়েছে। ভাস্কর্যটির কিছু কিছু অংশ বৃত্তাকারে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের রেকিট অ্যান্ড কোলম্যান অফিস এবং ঢাকার অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সামনের লনে নভেরার আরো দুটি কাজ আছে। কাজ দুটি আয়তনে তেমন বড় নয়, উচ্চতায় তিন ফুটের মতো। প্রথমটি অ্যাবস্ট্রাক্ট কাজ, দ্বিতীয়টি অ্যাবস্ট্রাকটেড মাতৃমূর্তি। ’৫৯ সালে নভেরা বার্মা (মিয়ানমার) গিয়েছিলেন বৌদ্ধমন্দির দেখার জন্য – সেখান থেকে ফিরে বুদ্ধের আসন বা পিস নামকরণে কয়েকটি কাজ করেছেন এবং কয়েকটি ফর্মে কাজটি করেছেন।

প্রদর্শনী
নভেরার প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল ১৯৬০ সালের ৭ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় গণ গ্রন্থাগার প্রাঙ্গনে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার) পাকিস্তান জাতিসংঘ সমিতির উদ্যোগে এবং এশিয়া ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায়। ইনার গেজ শিরোনামের ওই প্রদর্শনীটি ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী। প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আজম খান। পরের দিন সোমবার থেকে পরবর্তী দশদিন এই প্রদর্শনী সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। কেবলমাত্র ঘরের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে কিছু ভাস্কর্য গ্রন্থাগার প্রাঙ্গণেও প্রদর্শিত হয়েছিল। প্রদর্শনীতে ভাস্কর্য ছিল প্রায় পঁচাত্তরটি। এর প্রায় তিন যুগ পরে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে সে প্রদর্শনীর তিরিশটির বেশি ভাস্কর্য সংগৃহীত হয় এবং ১৯৯৮ সালে একত্রে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে প্রদর্শিত হয়।

নভেরার দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালে ব্যাংককে। এই প্রদর্শনীটি ছিল ব্যাংককে ধাতব ভাস্কর্যের প্রথম মুক্তাঙ্গন প্রদর্শনী। এতে নভেরা ধাতব মাধ্যমে কিছু ভাস্কর্য প্রদর্শন করেন। ব্রোঞ্জ ছাড়াও এ-পর্বে নভেরা তার ভাস্কর্যের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন শিট মেটাল এবং ঝালাইকৃত বা ওয়েলডেড ও স্টেইনলেস স্টিল। ব্যাংকক আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের আয়োজনে প্রদর্শনী চলেছিল ১৯৭০ সালের ১৪ থেকে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত, ২৯ থানন সাথর্ন তাই, আয়োজক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভবনে। প্রদর্শনী আয়োজনে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন থাইল্যান্ডে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত রব, শিল্পাকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আলংকারিক শিল্পকলা অনুষদের ডিন যুবরাজ ইয়াৎচাই চিত্রাবংস, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের ডিরেক্টর মাহমুদ-আল-হক। উদ্বোধন করেছিলেন শৌখিন চিত্রকর ও ভাস্কর যুবরাজ কারাবিক চক্রবন্ধু। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জুলাইয়ে তার তৃতীয় একক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়েছিল প্যারিসের রিভগেস গ্যালারিতে। সর্বশেষ ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসে তার পূর্বাপর কাজের একশ দিনব্যাপী একটি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশা এবং বিতর্ক

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার যেটি পাকিস্তান পুলিশ ও আর্মি ভেঙে ফেলে।
শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে নভেরা দেশে ফিরে আসেন। সে সময়ে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ চলছিল। ভাস্কর হামিদুর রহমান প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের কাজ শুরু করেন। এতে নভেরা আহমেদ জড়িত হন। স্থির হয় যে হামিদুর রহমানের নকশায় নির্মিত শহীদ মিনারে নভেরার তৈরি কিছু ভাষ্কর্য সংস্থাপিত হবে। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক আইন জারী হলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ফলস্বরূপ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের জন্য ভাষ্কর্য নির্মাণের কাজ নভেরা সম্পন্ন করার সুযোগ লাভ করেননি। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাতা হিসেবে তার নাম আর উচ্চারিত হয়নি। এ নিয়ে মৃদু বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই মনে করেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নকশাকারী হিসেবে নভেরার অবদান রয়েছে।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান শহীদ মিনারের পরিকল্পনা প্রণয়ন করার অনুরোধ করেন প্রধান প্রকৌশলী জব্বার এবং জয়নুল আবেদিনকে। জব্বার সাহেবের অন্যতম সহকর্মী ছিলেন প্রকৌশলী শফিকুল হক, নভেরার বড় বোন কুমুম হকের স্বামী। শহীদ মিনারের নকশার জন্য কাগজে কোনো বিজ্ঞাপন হয়নি। জয়নুল আবেদিন সরাসরি হামিদকে বলেছিলেন স্কেচসহ মডেল পেশ করতে। জাঁ দেলোরা তখন সরকারের স্থাপত্যবিষয়ক উপদেষ্টা। হামিদুর রাহমান শহীদ মিনারের যে মডেল ও স্কেচ উপস্থাপন করেছিলেন দেলোরা তার স্তম্ভগুলোর মাপ পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন।

নির্মিত ভাস্কর্য
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে অল পাকিস্তান পেইন্টিং অ্যান্ড স্কাল্পচার এক্সিবিশন আয়োজন হয়। সে সময়ে দশ বছর বয়সি একটি ছেলে ঘরের কাজে নভেরাকে সাহায্য করত। এই প্রদর্শনীর জন্য নভেরা তারই একটি আবক্ষমূর্তি তৈরি করলেন এবং নাম দিলেন চাইল্ড ফিলোসফার। এই ভাস্কর্যের জন্য তিনি সেই প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার লাভ করেন। অবয়বধর্মী ভাস্কর্য এক্সট্রিমিনেটিং এঞ্জেল, ছয় ফুটের অধিক উচ্চতাবিশিষ্ট স্টাইলাইজড ভাস্কর্যটিতে বিধৃত হয়েছে শকুনের শ্বাসরোধকারী একজন নারীর অবয়ব; নারীর হাতে অশুভ শক্তি ও মৃত্যুর পরাভবের প্রতীক। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে ভাস্কর হিসেবে নিজের একটা দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন নভেরা। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে নির্মিত ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে অধিকাংশই বেশ বড় আকারের; ৫ ফুট থেকে শুরু করে এমনকি ৭ ফুট ১১ ইঞ্চি পর্যন্ত উচ্চতাবিশিষ্ট।

একই বিষয়বস্তু নিয়ে নির্মিত একাধিক ভাস্কর্যের মধ্যে পরিবার (১৯৫৮), যুগল (১৯৬৯), ইকারুস (১৯৬৯) ইত্যাদি কাজে মাধ্যমগত চাহিদার কারণেই অবয়বগুলি সরলীকৃত। ওয়েলডেড স্টিলের জেব্রা ক্রসিং (১৯৬৮), দুটি লুনাটিক টোটেম ইত্যাদির পাশাপাশি রয়েছে ব্রোঞ্জ মাধ্যমে তৈরি দণ্ডায়মান অবয়ব। এছাড়া কয়েকটি রিলিফ ভাস্কর্য ও স্ক্রল। লুনাটিক টোটেম বা মেডিটেশন (১৯৬৮) এই দুটি ভাস্কর্যে শিল্পীর মরমি অনুভবের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কোথাওবা রয়েছে আদিম ভাস্কর্যরীতি থেকে পরিগ্রহণ। তবে একেবারে ভিন্ন রীতির কাজও ছিল এই প্রদর্শনীতে। বস্ত্ততপক্ষে তেত্রিশটি শিল্পকর্মের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ এগারোটিই ছিল পরিত্যক্ত ভাস্কর্য। ইন্দোচীনে ভূপাতিত মার্কিন যুদ্ধবিমানের ভগ্নাবশেষ থেকে তৈরি।

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ অবধি বিস্তৃত দীর্ঘ জীবনের তুলনায় নভেরা আহমেদের শিল্পকর্মের সংখ্যা কম। ষাট দশকের শেষভাগের মধ্যেই তার যা কিছু সৃষ্টি ও নির্মাণ। ১৯৭৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত প্যারিসের স্বেচ্ছানির্বাসনের জীবন পরিধিতি তিনি খুবই কম কাজ করেছেন। এ সময় অবশ্য তিনি কিছু ছবি এঁকেছেন।

অংকিত চিত্রকর্ম
১৯৭৩ থেকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্যারিসের স্বেচ্ছানির্বাসনের সময় তিনি বেশকিছু ছবি এঁকেছেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পর ৪৩টি চিত্রকর্মের হদিশ পাওয়া গেছে।

সংগ্রহ
নভেরা আহমেদের কাজের সর্ববৃহৎ সংগ্রহ রয়েছে ঢাকাস্থ বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। এছাড়া প্যারিসে তার স্বামী গেগ্ররী দ্য ব্রুনোর স্টুডিয়োতে ৯টি ভাষ্কর্য ও ৪৩টি অঙ্কিত চিত্র রয়েছে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের ঢাকাস্থ প্রধান কার্যালয়ের লবিতে দীর্ঘকাল রক্ষিত একটি ভাষ্কর্য ২০১৫’র শেষ ভাগে জাতীয় জাদুঘরে সংগ্রহ করা হয়। নভেরা আহমেদের পরিবার ও আরো একটি কাজ জাতীয় জাদুঘরের ৩৭ সংখ্যক গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হয়। পরিবার কাজটি ফার্মগটের কাছে এম আর খান স্যার এর বাড়ির উদ্যানে স্থাপিত ছিল যা ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় জাদুঘর সংগ্রহ করে এবং ২০১৬র মধ্যভাগ অবধি জাদুঘরের উদ্যানে সংস্থাপিত রাখে। পরে প্রাকৃতিক ক্ষতি এড়ানোর জন্য তা জাদুঘরের মূল ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। চট্টগ্রামের রেকিট অ্যান্ড কোলম্যান-এর বাংলাদেশ কার্যালয়ে এবং ঢাকার অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সামনের উদ্যানে নভেরার আরো দুটি কাজ সংস্থাপিত আছে।

পুরস্কার এবং স্বীকৃতি
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ভাস্কর হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি। ন্যাশনাল এক্সিবিশন অব পেইন্টিং স্কাল্পচার এ্যান্ড গ্রাফিক আর্টস শিরোনমে এই প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া তার ছ’টি ভাস্কর্যের মধ্যে চাইল্ড ফিলোসফার নামে একটি ভাস্কর্য বেস্ট স্কাল্পচারে পুরস্কৃত হয়। পরে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। তাকে নিয়ে নভেরা (১৯৯৫) শিরোনামে জীবনী উপন্যাস রচনা করেছেন হাসনাত আবদুল হাই। নির্মিত হয়েছে প্রামাণ্য চিত্র নহন্যতে (১৯৯৯)। এক সময় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের একটি হলের নামকরণ করা হয়েছিল ‘ভাস্কর নভেরা আহমেদ হল’। বর্তমানে বাংলা একাডেমী’র একটি হলের নাম নভেরা হল। তার ৮০ তম জন্মদিনে গুগল ডুডল তৈরি করে সম্মাননা প্রদান করে।

শেষ জীবন
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে দেশ ত্যাগ করার পর প্যারিসে বসবাস কালে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হন নভেরা, তবে বড় কোন আঘাত পাননি। মৃত্যু অবধি তিনি মানুষের সংসর্গ বাঁচিয়ে চলেছেন। রহস্যময় কারণে তিনি আর কখনো বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন নি। এমনকী বাঙ্গালী সংসর্গ এড়িয়ে চলেছেন। বাংলায় কথা বলতেও তার অনীহা ছিল প্রকট। কিন্তু ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে স্ট্রোকের ফলে হুইলচেয়ারে বসেই তার শেষ জীবন কাটে। ১৯৭৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে তার সৃষ্টি ও নির্মাণের সংখ্যা খুব কম।

মৃত্যু
২০১৪ থেকে নভেরা আহমেদ শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে তার অবস্থার অবনতি ঘটে। মৃত্যুর দুই দিন আগে তিনি কোমায় চলে যান। কয়েকদিন পর ৫ মে, মঙ্গলবার প্যারিসের স্থানীয় সময় ভোর তিনটা থেকে চারটার মধ্যে ৭৬ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়।

 

 
Electronic Paper