ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ | ১১ শ্রাবণ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বাংলা সাহিত্যের ধ্রুব নক্ষত্র

রোকেয়া ডেস্ক
🕐 ৩:৪৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২১

বাংলা সাহিত্যের ধ্রুব নক্ষত্র

শৈশবে অবাধ স্বাধীনতা ও উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠেন। মাঠে ঘাটে, নদীতে ঘুরে বেড়ানো, কখনো উঁচু গাছে চড়ে বাবাকে দেখে বকা খাওয়ার ভয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাওয়া, ভাইবোন এবং অন্যান্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে হল্লা করতে করতে স্কুলে যাওয়া ছিল তার নৈমিত্তিক কাজের একটি। সেদিনের সেই চঞ্চল স্বভাবের মেয়েটি আজকের কথাসাহিত্যিক, গবেষক এবং প্রাবন্ধিক সেলিনা হোসেন। জীবনের গভীর উপলব্ধির প্রকাশকে তিনি শুধু কথাসাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, শাণিত ও শক্তিশালী গদ্যের নির্মাণে প্রবন্ধ আকারেও উপস্থাপন করেছেন। সেলিনা হোসেনের কর্মময় জীবন নিয়ে লিখেছেন সাইফ-উদ-দৌলা রুমী

জন্ম ও শৈশব
সেলিনা হোসেনের পৈতৃক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলার হাজীরপাড়া গ্রামে। বাবা এ কে মোশাররফ হোসেন ছিলেন রাজশাহী রেশম শিল্প কারখানার পরিচালক। মা মরিয়মন্নেসা বকুল ছিলেন গৃহিণী। সেলিনা হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহী শহরে। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। বাবার কর্মস্থল বগুড়ায় তার শৈশব কাটে। তারা যেখানে থাকতেন সেটা ছিল রেশম চাষের এলাকা। বিশাল বিশাল তুতের বাগান। তার বাবা ছিলেন সেই অফিসের বড়বাবু। সেই এলাকার ভিতরে ছিল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাসস্থান, ডাকবাংলো রেশম-কীট পোষার ঘর। তুতের বাগান পার হয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা সড়ক ধরে পুলিশ লাইনের ভিতর দিয়ে কিংবা পাশ দিয়ে স্কুলে যেতেন। স্কুল থেকে ফেরার পথে টিলায় উঠে পুলিশের বন্দুকের গুলি থেকে বেরিয়ে আসা সীসা কুড়িয়ে হানিফের দোকান থেকে মুড়ি-মুড়কি, খুব ছোট ছোট রঙিন লজেন্স নিয়ে চিবুতে চিবুতে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা সড়ক ধরে বাড়ি ফেরার মধ্যে পেতেন এক অনাবিল আনন্দ।

বাড়ির কাছাকাছি এসে কে আগে পৌছাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলত চার ভাইবোনের মধ্যে। বাড়ি ফিরে পেটপুরে ভাত খেয়ে ছুটতেন মাঠের দিকে। গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, ছি-বুড়ি ইত্যাদি একেক রকম খেলা খেলতেন একেকদিন। সন্ধ্যা নামলেই ঘরে ফিরে হারিকেনের আলোয় পড়তে বসতেন। বাবা ছিলেন ভীষণ রাগী। চার-পাঁচ বছর বয়সের ছোট বোন লাকির মৃত্যু তার বাবাকে একদম বদলে দেয়। লাকির নেফ্রাইটিস অসুখ হয়েছিল। সে সময়ে ভালো চিকিৎসা না থাকায় লাকির নানা রকম চিকিৎসা চলতে লাগল। একজন কবিরাজ লাকিকে রাতে ধানের ওপর বসে থাকা শিশির খাওয়ানোর উপদেশ দেন। ছোট বোনকে সুস্থ করার জন্য ভাইবোনদের সঙ্গে তিনিও ধানখেতে গিয়ে শিশির ঝরিয়ে বাটি ভরে নিয়ে আসতেন। কিন্তু এরপরও ছোট বোনকে হারাতে হলো। মেয়েকে হারিয়ে তার বাবা একেবারে শান্ত হয়ে যান। আর কোনোদিন কোনো ছেলেমেয়ের গায়ে হাত তোলেননি।

শিক্ষা জীবন
পঞ্চাশ দশকে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয় বগুড়ার লতিফপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেসময়ে কাগজ কলমে লেখার রেওয়াজ না থাকায় পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি স্লেটে লিখতেন। স্লেটে শিক্ষক তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন লিখতে দিতেন এবং সেগুলো ঠিক হলো কিনা একজন আরেকজনকে যাচাই করতে দিতেন। একবার শিক্ষক একজনের সেøট অন্যজনকে শুদ্ধ করতে দেন। তার কাছে যার স্লেটটি পড়ে সে তার স্লেটে সঠিক উত্তরের জায়গায় টিক মার্ক এবং ভুল উত্তরের জায়গায় ক্রস চিহ্ন দেন। কিন্তু তার স্লেটটি যে ছেলেটির হাতে পড়ে সে দুষ্টুমি করে সঠিক বানান হিজিবিজি করে কেটে দিয়ে সেøটটি স্যারকে দেখায়। এটা দেখে তিনি রাগে দুঃখে ভীষণ কাঁদেন। কিন্তু সাহস করে স্যারকে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ছেলেটি তার যেসব বানান কেটেছে সেগুলো মুছে তিনি আবার লিখে দেবেন। স্যারের অনুমতি মিলল।

তিনি বানানগুলো শুদ্ধ করে লিখে স্যারকে দেখান। স্যার তো ছেলেটির কূটবুদ্ধি দেখে ভীষণ রেগে গিয়ে দু’ঘা লাগিয়ে দেন। পাশ থেকে অন্য সহপাঠীরা এ নিয়ে তাকে ব্যঙ্গ করে বলল, ‘দেখতে পুঁচকে হলে কী হবে, সাহস আছে।’ এই বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর রাজশাহী মহিলা কলেজে আই এ ক্লাসে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী। কলেজ শিক্ষক প্রফেসর আব্দুল হাফিজ ১৯৬৩-৬৪ সালে অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’ বইটি তাকে পড়তে দেন। বইটি পড়ে তিনি অভিভূত হয়ে যান। তার লেখালেখির শুরু ৬৪ বা ৬৫ সালের দিকে। এ সময় তার শিক্ষক আব্দুল হাফিজ তাকে পরামর্শ দেন, যদি সে শুধুমাত্র মেয়েদের পাতায় লেখালেখি করে তাহলে সেও একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে যাবে।

রাজশাহী কলেজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে ১৯৬৪ সালে রাজশাহী আন্তঃবিভাগীয় সাহিত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। তিনি এই প্রতিযোগিতায় গল্প লিখে প্রথম হয়ে চ্যাম্পিয়ানশিপ গোল্ড মেডেল পান। ওই বছরই রাজশাহী মহিলা কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে শিক্ষকরা শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করেন। তারা সেলিনা হোসেনকে ‘মেহেরজান’-এর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য নির্বাচিত করেন। এটা ছিল তার জীবনের প্রথম অভিনয়। তার বিপরীতে তাতারীর ভূমিকায় অভিনয় করে তারই বান্ধবী সুফিয়া। সেলিনা হোসেন রাজশাহী মহিলা মহাবিদ্যালয় থেকে আই.এ. পাস করে ওই কলেজেই অনার্স ক্লাসে ভর্তি হন। তাদের নিয়েই কলেজটি অনার্স খোলার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এক বছর পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি না পাওয়ায় তিনি ও আর সহপাঠী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ মাযহারুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন। অধ্যক্ষ তাদের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি করতে অপারগতা প্রকাশ করে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন।

এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে একথা ভেবে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তাই তারা দুজনে উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ শামসউল হকের সঙ্গে দেখা করে নিজেদের সমস্যার কথা জানান। উপাচার্য তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। এর কয়েকদিন পর বাংলা বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানেন তারা দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হতে পারবেন। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ঢাকার ‘পূবালী’ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়। ড. মাযহারুল ইসলাম, ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলামের সম্পাদনায় ‘উত্তর অন্বেষা’, ‘পূর্বমেঘ’ এবং ঢাকার ‘মাহে নও’, ‘পূবালী’ পত্রিকাতে তার লেখা ছাপা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে তিনি রাজনীতিতে অংশ নেন। তিনি ছাত্রী ইউনিয়নে (মতিয়া গ্রুপে) যোগ দেন। দলের পক্ষে সভা-মিছিলে অংশ নেন।

তিনি মন্নুজান হলের ছাত্রী সংসদের সাধারণ সম্পাদিকা এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের (রাকসু) দুবার সহকারী কমনরুম সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র পরিষদ বছরে একবার সাহিত্য প্রতিযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। তিনি ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করাসহ নাটকে অভিনয় করেন। সে সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এবং জিন্নাহ হলের প্রভোস্ট ছিলেন ড. জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। জিন্নাহ হলের বার্ষিক নাটকে অভিনয় করার জন্য তিনি সেলিনা হোসেনকে নায়িকা নির্বাচিত করে অভিনয় করতে বলেন। সেলিনা সঙ্গে সঙ্গে অভিনয় করতে প্রবল আপত্তি জানান। অধ্যাপক সিদ্দিকী তার বাবার কাছে ফোন করে বলেন যে ‘আপনার মেয়ে আমার কথা শুনছে না।’ শেষ পর্যন্ত শিক্ষকের তাগাদা এবং বাবার বকাবকিতে তাকে রাজি হতে হয়। তিনি ‘ক্ষুধা’ নাটকে নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য প্রতিযোগিতায় চারবার চ্যাম্পিয়ন হন।

ব্যক্তিগত জীবন
কলেজে পড়ার সময় বাড়িতে ঢাকা এবং লাইব্রেরি থেকে পত্রিকা আসত। এ সময় থেকেই তার পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্য বই পড়ার সুযোগ হয়। অনার্স পড়ার সময় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে তার প্রেম হয়। তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু পাত্র ২২ বছরের বড় হওয়ায় অভিভাবকরা প্রথমে বিয়েতে বাধা দেন। পরে অভিভাবকের সম্মতিতে ১৯৬৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তারা বিয়ে করেন। সংসার জীবনে তাদের ঘর আলো করে জন্ম নেয় দুই কন্যা সন্তান লাজিনা মুনা এবং ফারিয়া লারা। ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর স্বামী মারা গেলে তিনি দুই সন্তানকে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেন। তার মায়ের শরীরও ভালো যাচ্ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে হার্টের রোগে ভুগছিলেন। তারা বাসায় রেখে মায়ের চিকিৎসা সেবা করছিলেন।

১৯৭৩ সালে তার মা মারা যান। এর কিছুদিন পর আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। আবার মেয়েরা বাবার স্নেহ ভালোবাসায় বেড়ে উঠতে থাকে। পুত্র সাকিব আনোয়ারের জন্ম ১৯৭৭ সালে। তিনি মেয়েদের ভর্তি করে দেন উদয়ন স্কুলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাজিনা মুনা ১৯৯১ সালে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে স্নাতক ও ১৯৯২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ফারিয়া লারা ১৯৯২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক পাসের পরপরই পাইলট হওয়ার জন্য পাইলট প্রশিক্ষণে ভর্তি হন। মা হিসেবে সেলিনা হোসেন মেয়েকে একজন দায়িত্ববান পাইলট হওয়ার জন্য পারিবারিক সহায়তা এবং উৎসাহ দেন।

১৯৯৪ সালে লারা ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাস করেন। এ বছরই সেলিনা হোসেনের বাবা মারা যান। তখন তিনি লন্ডনে। লন্ডনে থাকার কারণে বাবাকে আর শেষ দেখা হলো না তার। এর দুই বছর পর লারা পাইলট প্রশিক্ষণে চমৎকার ফলাফল করে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সালে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশের কাছ থেকে প্রাইভেট পাইলটের লাইসেন্স অর্জন করেন। দুই বছর পরে ১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ লারা বাণিজ্যিক পাইলট লাইসেন্স লাভ করেন। এরপরই তিনি পাইলটদের প্রশিক্ষক হওয়ার প্রশিক্ষণ নেন। তিনিই বাংলাদেশের প্রথম নারী যিনি এই পেশায় আসেন। পাইলট হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি উড্ডয়নের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। ৫০ ঘণ্টার এই প্রশিক্ষণের শেষ দিনটি ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সালে বরিশাল থেকে ঢাকায় ফেরার পর পোস্তগোলা এলাকায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে লারা মৃত্যুবরণ করে।

পুরো পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। বড় মেয়ে লাজিনা মুনা ‘এইচআইভি এইডস’ এর ওপর লন্ডন স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৩ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ছেলে সাকিব আনোয়ার নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর শিক্ষকতা করার পর এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে কর্মরত রয়েছেন।

কর্মজীবন
সেলিনা হোসেনের কর্মজীবন শুরু হয় বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে। তিনি ১৯৬৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকাতে নিয়মিত উপসম্পাদকীয় লিখতেন। ১৯৭০ সালে দুটো চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য চিঠি পান। একটি বাংলা একাডেমিতে অন্যটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে সরকারি কলেজের জন্য। বাংলা একাডেমির চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন একাডেমির তৎকালীন পরিচালক কবীর চৌধুরী, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, আবদুল্লাহ আলমুতী শরফুদ্দীন প্রমুখ।

তিনি বাংলা একাডেমিতে গবেষণা সহকারী পদের জন্য ইন্টারভিউ দেন। একই দিনে একই সময়ে সেখানে পাণ্ডুলিপি পাঠক পদেও ইন্টারভিউ হচ্ছিল। ড. মুহম্মদ এনামুল হক তাকে বললেন, ‘পুথি পড়তে পার?’ তিনি বলেন ‘পারি।’ ড. মুহম্মদ এনামুল হক সেলিনার দিকে তাকিয়ে চারশত বছর আগের পাণ্ডুলিপি ঠেলে দিয়ে বললেন ‘পড়ো।’ সেলিনা সুর করে পুথি পড়ে শোনান। কারণ এম এ ক্লাসে তাদের পুরনো পাণ্ডুলিপি পাঠ করা শেখানো হতো। ভীষণ রাগী পণ্ডিত মানুষ ড. মুহম্মদ এনামুল হক তার নির্ভুল পাঠ শুনে এমন একটি হাসি দেন যা সেলিনা কখনো ভুলেননি। ড. এনামুল হক তখনও জানতেন না যে ‘ড. মো. এনামুল হক স্বর্ণপদক প্রতিযোগিতায়’ যে প্রবন্ধটি জমা দিয়েছিলেন তার জন্য তিনিই নির্বাচিত হয়েছিলেন।

তিনি বিশ্বাস করেন প্রবন্ধটিও চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এর পাশাপাশি পাবলিক সার্ভিস কমিশনে সরকারি কলেজের চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বোর্ডে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে পান। এম.এ. পাস করার পরে তার শিক্ষক আব্দুল হাফিজ তাকে বলেছিলেন বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে লেখা প্রকাশিত গল্পগুলো নিয়ে একটি বই করতে। যে বইটি তার বায়োডাটাকে খানিকটা সমৃদ্ধ করবে। সে সময়ে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ঢাকা টেলিভিশনে বই বিষয়ে একটি অনুষ্ঠান করতেন। সেই অনুষ্ঠানে তিনি সেলিনা হোসেনের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ আলোচনা করেছিলেন। ইন্টারভিউ বোর্ডে মুনীর চৌধুরী সেলিনাকে বলেন, ‘গল্পগুলো তো ভালোই লিখেছ।’ কলেজের চাকরিটাও তার হয়। তাকে পোস্টিং দেওয়া হয় সিলেটের এম সি কলেজে। সে সময়ে তার ছোট মেয়ে লারার বয়স দুই মাস থাকায় তিনি কলেজের চাকরিটি গ্রহণ না করে সরকারি কলেজ থেকে অর্ধেক বেতনে বাংলা একাডেমির চাকরিতে যোগদান করেন। সে সময়ে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে পড়ে আসা একটি মেয়ের ঢাকার মতো অজানা অচেনা বন্ধুহীন আত্মীয়হীন শহরে একসঙ্গে দুটো চাকরি জোগাড় করা খুব আয়াসসাধ্য কাজ ছিল না।

কর্মরত অবস্থায় তিনি বাংলা একাডেমির ‘অভিধান প্রকল্প’, ‘বিজ্ঞান বিশ^কোষ প্রকল্প’, ‘বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলী প্রকাশ’, ‘লেখক অভিধান’, ‘চরিতাভিধান’ এবং ‘একশত এক সিরিজের’ গ্রন্থগুলো প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়াও ২০ বছরেরও বেশি সময় ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক হন। ২০০৪ সালের ১৪ জুন চাকরি থেকে অবসর নেন।

ক্ষেত্রভিত্তিক অবদান
ষাটের দশকের মধ্যভাগে রাজশাহী মহিলা কলেজে পড়ার সময়ে তার লেখালেখির সূচনা। সেই সময়ের লেখা নিয়ে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘উৎস থেকে নিরন্তর’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। তার দুটি গ্রন্থ ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ এবং ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। তার কয়েকটি গল্প নিয়েও নাটক নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক। ১৯৯৮ সালের ১০ অক্টোবর তার ছোট মেয়ে ফারিয়া লারার শোকসভায় মেয়ের নামে কিছু করার সিদ্ধান্ত নেন। পারিবারিক সিদ্ধান্তে ১৯৯৯ সালে ফারিয়া লারা ফাউন্ডেশন এবং মা ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার কথা ভেবে রাজেন্দ্রপুরের হালডোবা গ্রামে দুই কক্ষ বিশিষ্ট ‘মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা প্রকল্প’ প্রতিষ্ঠা করেন। অনানুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা কেন্দ্র খোলা হয়।

২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে রোগীদের চিকিৎসা সেবাকে আরও প্রসার করার জন্য একটি প্যাথলজিক ইউনিট খোলা হয়। একজন প্যাথলজিক টেকনিশিয়ানের দ্বারা এটি পরিচালনা করা হয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে এক লাখ ২৪ হাজার ১৬৭ জন রোগী চিকিৎসা সেবা পান। এছাড়াও তিনি গণ সাহায্য সংস্থা, রিসার্চ ইনিসিয়েটিভ বাংলাদেশ, ব্রতী, ইউ এস সি কানাডা-বাংলাদেশ, প্রিপ ট্রাস্ট, ডি.নেট ইত্যাদি সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে যুক্ত।

তিনি ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে মেলবোর্নে বসবাসরত বাঙালিদের সংগঠন বাংলা সাহিত্য সংসদের আমন্ত্রণে মেলবোর্নে যান। সেখানে তারা তার সাহিত্যকর্ম বিষয়ে আলোচনা করে, উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করে। তার উপন্যাসভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ অংশ বিশেষ দেখায়। তিনি ১৯৬৯ সালে প্রবন্ধের জন্য পান ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক, ১৯৮০ সালে উপন্যাসের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ১৯৮১ সালে ‘মগ্নচৈতন্যে শিস’ উপন্যাসের জন্য আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮২ সালে অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৭ সালে ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ উপন্যাসের জন্য কমর মুশতারী পুরস্কার, ১৯৯৪ সালে ‘অনন্যা’ ও ‘অলক্ত’ পুরস্কার পান। এছাড়া ১৯৯৪-৯৫ সালে তিনি তার এয়ী উপন্যাস ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ রচনার জন্য ফোর্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ পান।

১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ইংরেজি, হিন্দি, মারাঠি, কানাড়ি, রুশ, মালে, মালয়ালাম, ফরাসি, জাপানি, ফিনিস, কোরিয়ান প্রভৃতি ভাষায় তার বেশ কয়েকটি গল্প অনূদিত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ পায়। ২০০০ সালে প্রকাশিত হয় ‘টানাপোড়েন’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ ২০০১ সালে মালয়ালাম ভাষায় অনূদিত এবং ভারতের কেরালা প্রদেশ থেকে প্রকাশিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ‘যাপিত জীবন’ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ‘নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি’ উপন্যাস পাঠ্যসূচিভুক্ত।

শিলচরে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি উপন্যাস এমফিল গবেষণাভুক্ত। ২০০৫ সাল থেকে শিকাগোর ওকটন কলেজের সাহিত্য বিভাগ দক্ষিণ এশিয়ার সাহিত্য কোর্সে তার ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাসটি পাঠ্যসূচিভুক্ত হয়। ২০১০ সালে একুশে পদক পান সেলিনা হোসেন। ওই বছরেই রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট উপাধি দেয়। সেলিনা হোসেনের উপন্যাসের সংখ্যা ২৬টি, গল্পগ্রন্থ ১৮টি, প্রবন্ধগ্রন্থ নয়টি, সম্পাদনা গ্রন্থ ছয়টি, শিশুতোষ গ্রন্থ ১২টি।

 
Electronic Paper