ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ | ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মায়ের অসুখ

ইমরান পরশ
🕐 ৬:৪০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৯, ২০২২

মায়ের অসুখ

কি রে মা, কী হয়েছে তোমার?
আলতো করে মাযের কপালে হাত রাখে মাহিম। প্রচণ্ড জ্বর শরীরে শুয়ে আছেন মিতু বেগম। মাথায় জলপট্টি দেওয়া। মালসার (মাটির বাসন) পানিতে কাপড় ভিজিয়ে মায়ের কপালে লাগিয়ে দিচ্ছে মাহিম। মাঝে মাঝে নিজের মুখখানি মায়ের কপালে রেখে পরম ভালোবাসায় মাকে জড়িয়ে ধরছে। আর নীরবে চোখ থেকে গরম জল গড়িয়ে পড়ছে গালে।

মায়ের অসুস্থতা তাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে না। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলাও বন্ধ। মায়ের অসুস্থতা তার জীবনকে স্থবির করে দিয়েছে। কুপির আলোটা হঠাৎ হালকা বাতাসে বাঁক খেলো আর অমনি মাহিম চমকে উঠল। এই বুঝি আজরাইল এলো। আজরাইল এলে কি বাতাস হয়? হতেও পারে, ভাবে মাহিম। সে দু’হাত তুলে কাঁদতে থাকে। ও আজরাইল তুমি আমাকে দেখা দাও, আমার মায়ে রে তুমি নিও না। এই দুনিয়ায় মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তুমি যদি নিতে চাও তাহলে আমাকেও সঙ্গে নাও। মাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। আমাকে কে খাইয়ে দেবে। কে আমাকে গোসল করিয়ে দেবে। আমি তো একা কিছুই করতে পারিনে।
নিঃশব্দে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে আজরাইলের নিকট প্রার্থনা করে সে। তার বুকফাটা কান্নায় যেন আকাশও গুমরে কেঁদে উঠেছে। একঝাঁক ঠাণ্ডা বাতাস এসে শীতল পরশ বুলিয়ে গেল। কখন আজরাইল আসবে আর তার সঙ্গে কথা বলবে মায়ের প্রাণ ভিক্ষা চাইবে সেই অপেক্ষায় ঘুমহীন চোখে পানি ছিটিয়ে নেয়। মা বলেছেন- বাবা রে, যেদিন আজরাইল আসবে সেদিন আর কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। আজরাইল কে? মাহিম তা জানে না। তাই জানতে চাইল- মা, আজরাইল কেমন?
তার ইয়া বড় পা আসমান সমান লম্বা। যখন নামে, পা দুইখান মাটিতে আর মাথা ঠেকে আসমানে। আজরাইল এলে কি ঝড় হয়?
সব সময় হয় না রে বাপ। তয় যখন জান কবজ করে তখন নাকি অনেক কষ্ট হয়।
তাইলে আমি দরজা বন্ধ করে রাখব। যেন আজরাইল না আসতে পারে। বলল মাহিম।
পাগল ছেলে! আজরাইল কি দেখা যায়? হাসেন মিতু বেগম।
তাইলে তুমি যে বললা পা মাটিতে আর মাথা আসমানে ঠেকে।
বাবা রে আজরাইল রে সেই দেখতে পায় যখন যার জান কবজ করতে আসে।
মিতু বেগমের একমাত্র ছেলে মাহিম। মাহিমের বাবা দীর্ঘদিন যাবত দুবাই প্রবাসী। সেই যে বিয়ের চারমাসের মাথায় বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন অদ্যাবধি কোনো খোঁজ নেই তার। যাদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে বিদেশে গিয়েছিলেন, সেই পাওনাদারদের চাপে জমিজমা যা ছিল বিক্রি করে তাদের দেনা পরিশোধ করেছেন মিতু বেগম। সহায় সম্বল বলতে ভিটেবাড়িটুকু আছে। তাও আবার বাবার বাড়ি থেকে ওয়ারিশ সূত্রে পেয়েছেন। মাহিম ক্লাস ফোরে পড়ছে। কতইবা আর বয়স, দশ বছরে পড়েছে। এ বয়সের একটি বালকের কতটুকুইবা জ্ঞান থাকে!
পাশের গ্রামে সেই কবে বিদ্যুৎ এসেছে অথচ তাদের গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। যাদের সামর্থ্য আছে তারা কেউ কেউ সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করছেন। আর অধিকাংশ বাড়িতেই সেই মান্ধাতা আমলের চেরাগ বাতি। হারিকেনের আলোয় সবাই রাতের অন্ধকারকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। কেউ আবার চার্জার লাইট বাজার থেকে চার্জ করিয়ে এনে দৈনন্দিন চাহিদা মেটান। একটিমাত্র সন্তানকে নিয়ে বাপ-ভাইয়ের দেওয়া একটুকরো জমির উপর, দশখান টিনের একটি ছাপড়াঘর তুলে সেখানেই বসবাস করছেন মিতু বেগম। একটি সেলাই মেশিন দিয়ে কোনোরকমে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন। সেলাই মেশিনটি স্থানীয় সংসদ সদস্য দিয়েছেন। বাজার থেকে কিছু বাড়তি অর্ডার নিয়ে কাজ করায় বাড়তি কিছু আয়ও হচ্ছে। ছেলেটাকেও লেখাপড়া করাচ্ছেন। মাহিম যখন দুই মাসের পেটে তখনই দবির মিয়া মানে মাহিমের বাবা বিদেশে চলে যায়। মাহিমের মা লোকমুখে শুনেছেন ট্রলার দিয়ে সাগর পাড়ি দেওয়ার সময় ট্রলারের অনেকেই ডুবে মারা গেছে। আর কেউ কেউ পার্শ্ববর্তী দেশের জেলে রয়েছে। কিন্তু কোন দেশের জেলে তা কিউ ঠিকমতো বলতে পারে না। তাই তার খোঁজও নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে বেঁচে থাকলে একদিন ফিরবেই। মাহিমের নানা-নানি মারা যাওয়ার পর থেকেই যেন তারা একা হয়ে যায়। এক মামা আছেন তিনি আবার ঢাকায় থাকেন। গ্রামে ঠিকমতো আসেন না।
রাতের আকাশে তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে। ঘরের ভেতর দুএকটি জোনাক পোকা মিটমিট করে আলো জ্বেলে চলছে। অন্ধকারে মিনি টর্চলাইটের মতো মনে হয় জোনাকিগুলোকে। টিনের উপর কীসের যেন আওয়াজ হলো আর অমনি মাহিম চমকে উঠল। এই বুঝি আজরাইল এলো! তার একটিমাত্র চিন্তা যদি আজরাইল এসে মাকে নিয়ে যায় তাহলে তো আর পৃথিবীতে আপন কেউই থাকবে না। কুপির আলো মাঝে মাঝে ফটফট করে শব্দ ছড়ায়। কেরোসিনের সঙ্গে ডিজেল মেশানো হলে নাকি এই সমস্যা বেশি হয়।
হঠাৎ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যায় মাহিম। শব্দ পেয়ে হুড়মুড়িয়ে ওঠে। মায়ের কপাল থেকে কাপড়টা সরিয়ে নেয়। মায়ের নাকের কাছে হাতটি নিয়ে দেখে শ্বাস বইছে কি না। হ্যাঁ গরম নিঃশ্বাস বের হচ্ছে। প্রচ- জ্বরে মা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। কী করবে মাহিম ভাবতে পারছে না। পাশের বাড়ির নাজমা খালাকে ডাক দেবে কি না ভাবছে। থাক এত রাতে ডাকলে যদি আবার রাগ করে তাই চুপ করে থাকে। তার একটাই ভাবনা আজরাইলকে নিয়ে। হঠাৎ যদি এসে পড়ে আর সে বুঝতে না পারে। তাহলে তো মাকে হারাবে। তাই আজরাইল এলে তার কাছ থেকে মাকে ভিক্ষা চেয়ে নেবে। আর সে যদি আজরাইলকে বোঝাতে পারে তাহলে তার কথা না রেখে পারবেই না। মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকতে থাকে। যেন তার কাছ থেকে মাকে কেউ ছিনিয়ে নিতে না পারে।
মাকে কী ডাকবে নাকি ডাকবে না ভাবতে থাকে। মায়ের শরীরটা ক্লান্ত হয়ে গেছে একটু ঘুমিয়েছে ঘুমোক। মায়ের কপালে আবার হাত রাখে মাহিম। মনের ভেতর খুশির আলো ঝিলিক মেরে ওঠে। মায়ের জ্বর অনেক কমে গেছে। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি গরম। প্রথমে যেমনটি ছিল তেমন না। ঘরের পেছনে একটা কানাকুয়ো পাখি ডেকে উঠল। ডাহুকের ডাক ভেসে এলো কানে। হঠাৎ শেয়ালের কোরাস ধ্বনিতে কেঁপে ওঠে মাহিমের শরীর। বাড়ির উত্তর পাশে বাঁশবাগান। ওখানে প্রায়ই শেয়ালের আনাগোনা। কয়েকদিন আগে রুবেলদের একটা ছাগলের বাচ্চা ধরে নিয়ে গিয়েছিল শেয়ালে। আর বনবিড়াল তো প্রতি রাতেই আসে। খোয়াড়ের ফাঁকফোকরে তার সুচারু হাতটি ঢুকিয়ে হাঁস-মুরগির পা থেকে পাখনা যা পায় ছিঁড়ে নিয়ে চলে যায়। আর ছোট বাচ্চা হলে তো অনায়াসেই বের হয়ে আসে। আর বেচারার সে কি গোঙানি। মাহিমের একটি মুরগির পা ছিঁড়ে নিয়েছিল সেদিন।
মা সেটাকে জবাই করে ভুনা করে দিয়েছিলেন। মায়ের হাতের রান্না অনেক সুস্বাদু। হঠাৎ মায়ের ঘুম ভেঙে যায়। পাশ ফিরতেই দেখেন তার আদরের ধন বসে রয়েছে।
কি রে বাবা, তুমি ঘুমাওনি?
না মা। তোমাকে এই অবস্থায় রাইখা কেমনে ঘুমাই। তোমার জ্বর সারছে মা?
এই জ্বরে আর কী হয় রে বাপ!
পরম স্নেহে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। আর অমনি মাহিমের চোখ যেন বাঁধহীন স্রোতধারা হয়। মাকে জড়িয়ে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে চোখে ঝরনা বইয়ে দেয়। মা, আমি তোমাকে পাহারা দিছি। যদি আজরাইল আসে?
পাগল ছেলে বলে কী! আজরাইলকে কি কেউ দেখতে পায়? যার যখন সময় হবে তখন তাকে এমনিতেই চলে যেতে হবে। পূর্ব আকাশ ফর্সা হয়ে আসে। মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেদ করে যায় রাতের সীমানা। মিতু বেগম দেখেন মাহিম ঘুমিয়ে পড়েছে।
পাখির বাচ্চা যেমন মায়ের ডানার নিচে মুখ লুকিয়ে রাখে, তেমনিভাবে মাহিমও মায়ের বুকের ভেতর লুকিয়ে গেল। ছেলেকে পরম স্নেহে বুকে টেনে নেন মিতু বেগম।

 
Electronic Paper