ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ | ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

মশক নিধনে ‘বৈষম্য’ দুই সিটিতে

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১২:৪৭ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯

চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ডেঙ্গুর প্রকোপ চরমে পৌঁছলে নড়েচড়ে বসে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয় মশক নিধনে। তবে ঢাকার দুই সিটির মশার ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়েক মাস মশক নিধনে জোরেশোরে মাঠে নামে দুই সিটি। কিন্তু এখন আবার সেই আগের মতোই ঢিলেঢালা মশা ওষুধ ছিটানোর কর্মসূচি। আবার এলাকা ভেদে ওষুধ ছিটাতেও ‘কম বেশি’ তারতম্য আছে। আর এটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই।

সরেজমিন দেখা যায়, দুই সিটিরই উন্নত এলাকাগুলো তুলনামূলক পরিচ্ছন্ন। ফলে সেখানে মশক প্রজননের সুযোগ কম। আর নিম্নাঞ্চল বা তুলনামূলক দরিদ্র মানুষের বাস রয়েছে- এমন এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি। অপচ্ছিন্নতার কারণে এখানে সব ধরনের মশার প্রজনন উপযোগিতা রয়েছে।

এদিকে নগর কর্তৃপক্ষ মশক নিধনে কাজ করলেও নিম্নাঞ্চল অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত দরিদ্ররা বাস করেন- এমন এলাকাগুলোতে তাদের কার্যক্রম দেখা যায় নামমাত্র। অন্যদিকে মশার উপদ্রব কম থাকার পরেও মশককর্মীদের তৎপরতা বেশি উন্নত এলাকায়। ফলে নাগরিক সেবা দিতে নগরের বাসিন্দাদের দুই চোখে দেখা হচ্ছে বলে অভিযোগ এসব এলাকার বাসিন্দাদের। গত জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে মহামারী আকার ধারণ করে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। এ চার মাসে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় কয়েক লাখ মানুষ। এদের অধিকাংশ চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেও প্রাণ হারান তিন শতাধিক মানুষ। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে ঢাকায়। যদিও সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় এক লাখ আর মৃতের সংখ্যা ১৩৩ জন।

সারা বছরের জন্য মশক নিধন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সে অনুযায়ী কাজও চলছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এর সুফল নিয়ে। নগরের উন্নত এলাকাগুলোতে করপোরেশনের কর্মীদের কর্মযজ্ঞ চোখে পড়লেও অনুন্নত এলাকাগুলোতে মশককর্মীদের দেখা নেই। ফলে এসব এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তি এখন চরমে।

মোহাম্মদপুরের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের রামচন্দ্রপুর খাল এলাকায় কিউলেক্স মশার উপদ্রব এখন মাত্রাতিরিক্ত। সন্ধ্যার পর ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, খাল এলাকায় মশককর্মীদের শেষ কবে দেখা গিয়েছিল তা তারা নিজেরাও বলতে পারেন না। স্থানীয় তারেক জানান, মশার ওষুধ তো ছিটাতে দেখি না। এদিকে মাস খানেক আগে একবার দেখছিলাম, তারপর আর কেউ আসেনি। সন্ধ্যার পর মশার কামড়ে বাইরে আসা যায় না। সোহাগ নামে অপর একজন বলেন, মাসে মশা তাড়াতে আমার খরচ ১১০০ টাকার বেশি। আমাকে যদি এত টাকা খরচ করতে হবে, তাহলে সিটি করপোরেশনের কাজ কী?

মশকনিধন কর্মীদের কর্ম বণ্টনের দায়িত্ব রয়েছেন করপোরেশনের একজন সুপারভাইজার সালাউদ্দিন। তিনি জানান, পরদিন ওষুধ দেওয়া হবে। কিন্তু এরপর এক সপ্তাহের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও মশক কর্মীর দেখা মেলেনি। একই চিত্র শেকেরটেক ও আদাবর এলাকায়। মূল সড়ক ও আবাসিক এলাকায় মশক কর্মীদের নিয়মিত দেখা মেলে। কেবল তাদের দেখা পান না এলাকায় বেড়িবাধ ও খাল সংলগ্ন এলাকার মানুষ।

আদাবর সুনিবিড় হাউসিং এলাকার বাসিন্দা মুনসুর বলেন, আমি মনসুরাবাদে চাকরি করি। সেখানে ওষুধ দেয়। কিন্তু আমাদের এদিকে দেয় না। আমরা তো বিচার দিতে পারব না। তাই তারা আমাদের এদিকে ওষুধ দেয় না।

ঢাকা উত্তরের খিলক্ষেত এলাকায় বিমানবন্দর সড়কের পাশে কোনো আবাসিক স্থাপনা না থাকলেও সেখানে মশককর্মীদের কর্মযজ্ঞ দেখা মেলে। কাজের ব্যস্ততা দেখা যায় খিলক্ষেতের নামিদামি এলাকায়। কিন্তু এই এলাকার ভেতরের অংশে তাদের প্রবেশ করতে দেখা যায় না। খিলক্ষেতের মতো একই অবস্থা মগবাজার, মধুবাগ, রেলগেট, মীরবাগ, মীরেরটেক মোহাম্মদপুরের নবীনগর, সাত মসজিদ হাউজিং, চাঁদ উদ্যান, দয়াল হাউজিং, রায়েরবাজার, মিরপুরের দিয়াবাড়ি, মাজার রোড, কালসি, শেওরাপাড়া খাল, তুরাগের ধউর, উত্তরার উত্তরখান, দক্ষিণ খান, মাণ্ডা-মুগদা খাল, কুড়িল, কামরাঙ্গীর চর, পুরান ঢাকার ইসলামবাগ, সোয়ারিঘাট, বাবুবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা। এসব এলাকায় মশক নিধন কার্যক্রমে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের অনেকেরই গাফেলতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিয়মিত মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনার কথা থাকলেও বাস্তবে তার দেখা নেই এব এলাকায়। করপোরেশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া নাম্বারে ফোন করে মশক কর্মীদের ফোন করা হলেও এদের দেখাও মিলছে না।

ধনী শ্রেণি মানুষের বাসের জায়গার বিপরীতে ঢাকার নিম্নাঞ্চল এবং তুলনামূলক দরিদ্র মানুষের এলাকায় মশক নিধনের কার্যক্রম নামমাত্র বলে প্রকারান্তরে স্বীকার করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ। জনবল কম থাকার কারণে এমনটি হতে পারে বলে তার ভাষ্য। তিনি বলেন, নতুন অঞ্চলগুলোতে আমাদের জনবল কম। আমরা প্রতি ওয়ার্ডে ১০ জন করে নতুন করে লোক নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। এতে করে সমস্যা অনেকটাই কমে আসবে।

বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ডেঙ্গু। কিন্তু একেবারে নির্মূল হয়নি। এখনো রাজধানীসহ সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীর দেখা মিলছে। মাঝে মধ্যে ঘটছে প্রাণহানিও। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩০১ জন।

এর মধ্যে ঢাকার ৪১টি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ১৯২ জন এবং অন্য বিভাগে ১০৯ জন। তবে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমলেও শীতের শুরুতে উপদ্রব বেড়েছে কিউলেক্স মশার। কুয়াশা এবং ছায়াযুক্ত পরিবেশে প্রজনন উপযোগিতা পায় ডেঙ্গু। ফলে কর্তৃপক্ষ আগাম সতর্ক না হলে পুরো শীতকাল মশার উপদ্রব চরমে পৌঁছতে পারে।

 
Electronic Paper