ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ | ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের রেশ বিএনপির তৃণমূলে

মাহমুদুল হাসান
🕐 ১১:৩৭ পূর্বাহ্ণ, মে ২২, ২০২৪

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের রেশ বিএনপির তৃণমূলে

# হতাশ হচ্ছেন নেতাকর্মীরা
# দুই মহানগরে নতুন নেতৃত্বের খোঁজ

সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনে নেতৃত্ব এবং কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে বিএনপিতে। কোথাও কোথাও এ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে, আবার কোথাও দলের নেতাকর্মীদের আলোচনার টেবিলে উঠে আসছে এসব দ্বন্দ্ব। এতে দলের তৃণমূল পর্যায়ে তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ। বাড়ছে হতাশা। নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন বহু নেতাকর্মী।

জানা গেছে, আন্দোলনে নিজেদের ব্যর্থতা ডাকতে একে অপরের প্রতি দায় চাপাচ্ছে নেতাকর্মীরা। কর্মসূচি বাস্তবায়নে আর্থিক বরাদ্দ নিয়েও তোলা হচ্ছে প্রশ্ন। এ নিয়ে দায়িত্বশীল নেতারা ক্ষুব্ধ এবং হতাশ। যার প্রভাব তৃণমূল পর্যায়েও পড়েছে। এছাড়া সাংগঠনিকভাবে পুনর্বিন্যাস নিয়ে দলের আলোচনা বাস্তবায়ন না হওয়াতে অনেক হাতাশা ব্যক্ত করেছেন।
দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরপরই বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে বছরব্যাপী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। গতানুগতিক কর্মসূচির পাশাপাশি দল গোছানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যার ধারাবাহিকতায় ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। ঢাকা মহানগর বিএনপিসহ অঙ্গ দলগুলোও পুর্নগঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্য পূরণ চলমান প্রক্রিয়া বলে বলে জানান নেতারা।

ছাত্রদলের নতুন কমিটি ঘোষণার পর থেকে অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনগুলোর পদপ্রত্যাশীরা আশা বুক বাঁধতে থাকেন। কিন্তু সময়ের সাথে তা যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই হতাশ হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন।

তবে দলীয় সূত্র জানায়, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, শ্রমিক দল, জাসাস, তাঁতী দল, মৎস্যজীবী দল পুর্নগঠন করা হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, দলীয় সংগঠন গঠন এবং পুনর্গঠন একটি দলের নিয়মিত কার্যক্রম। দল হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, কর্মীদের মতামত ও ভোটের মাধ্যমে বটমআপ কনসেপ্টের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর কমিটি নির্বাচিত হবে।

তিনি বলেন, সরকার বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা করছে। বিভিন্ন পর্যায়ের কাউন্সিল অনুষ্ঠান সরকার কর্তৃক বিঘ্নিত হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ আসুক। তারই ফলশ্রুতিতে আমরা যেন অতিসত্বর আমাদের জাতীয় কাউন্সিলসহ মেয়াদোত্তীর্ণ সকল কমিটি পুনর্গঠনের জন্যে একটি শান্তিপূর্ণ ও নির্ভয় পরিবেশ ফিরে পাই।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, সংগঠন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। কখন কোন কমিটি পরিবর্তন হবে তা দিনক্ষণ ঠিক করে হয় না। আমরা আন্দোলনে আছি। পাশাপাশি সাংগঠনিক কার্যক্রমও অব্যাহত রাখছি।

দুই মহানগরে নেতৃত্বের খোঁজে বিএনপি: আন্দোলনের ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরুতে পারছে না বিএনপি। আন্দোলনের প্রাণ কেন্দ্র রাজনীতি ঢাকা। সেখানে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে বিএনপির মহানগর কমিটি। সঠিক নেতৃত্ব না পেয়ে হতাশ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙতে নতুন নেতৃত্ব খোঁজছেন দলটির হাইকমান্ড।

ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপিতে পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেছে। মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বাক আমান উল্লাহ আমান কারামুক্ত হলেও তাকে দায়িত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক হিসেবে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারকে মহানগর উত্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শোনা যাচ্ছে আমানকে আর দায়িত্ব ফিরৎ দেওয়া হবে না। মহানগরে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হবে। যে কারণে নেতৃত্ব খোঁজা হচ্ছে। একই সঙ্গে ঢাকা মহানগর দক্ষিণেও নতুন নেতৃত্ব খোঁজা হচ্ছে।

মহানগর উত্তর বিএনপি সূত্র জানায়, উত্তরে(মহানগর বিএনপি উত্তর) ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিব দুই জন দুই মেরুতে। শীর্ষ দুই নেতার দ্বন্দ্ব এখন অনেকটা প্রকাশ্যে। দুই নেতার অনুসারিরা একে অপরে কুৎসা রটাচ্ছে। এই নিয়ে বিব্রত ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক। এই নিয়ে তিনি দলের ঘনিষ্টদের বলেছেন, দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করতে সুযোগ না পেলে সরে দাঁড়াবেন।

ঢাকা মহানগর বিএনপি উত্তরের যুগ্ম আহ্বায়ক ফেরদৌস আহমেদ মিষ্টি খোলা কাগজকে বলেন, মহানগর বিএনপি উত্তর কমিটি ভালোই চলছে। ৩০ মে আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়াউর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকীর প্রোগ্রামের প্রস্ততি নিচ্ছেন।

তিনি বলেন, সাংগঠনিক ভাবে প্রতি থানা ওয়ার্ডের সাথে বসে আলোচনা করা হচ্ছে। দলের যৌথ সভা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যে নির্দেশনা দেবেন। তারা সেই কর্মসূচি পালন করবেন মহিলা দল চলে দলের শীর্ষ এক নেতার ইশারায়! দীর্ঘ দিন ধরে মহিলা দলের দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব। বিভিন্ন সময় দুই নেতৃত্বের অনুসারীদের মধ্যে মাঝে মধ্যেই মারামারি ঘটনাও ঘটেছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর উত্তরে মহিলাদলের সম্মেলন হওয়া ছয়টি থানা কমিটি অনুমোদন নিয়ে স্বাক্ষর জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। পরে কমিটিগুলো বাতিল করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে ছয়টি থানা কমিটির সব নেত্রী একযোগে পদত্যাগ করেছেন।

জানা গেছে, বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতা মহিলাদলের দায়িত্বশীল নেতাকে ফোন করে কমিটিতে স্বাক্ষর করার বিষয়টি অস্বীকার করতে বলেন। যদিও ঐ নেত্রী বিষয়টি প্রকাশ্যে আনতে নারাজ।

গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক নায়াব ইউসুফ এবং সদস্য সচিব রুনা লায়লা স্বাক্ষরিত দলীয় প্যাডে গুলশান, বনানী, বাড্ডা, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর এবং মিরপুর থানা কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে গণমাধ্যমে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি জানানো হয়। কিন্তু নিজ স্বাক্ষর নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা দলের আহ্বায়ক নায়াব ইউসুফ। তিনি দাবি করেন, এ স্বাক্ষর তার নয়, এটি জালিয়াতি করা হয়েছে।

মহিলা দলের অনেকে দাবি করেছেন নায়াব ইউসুফই স্বাক্ষর করেছেন। এর আগেও কমিটিতে তিনি স্বাক্ষর দিয়ে অন্যের চাপে এবং ভয়ে পরে অস্বীকার করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা পদত্যাগ করেছেন তাদের সিংহভাগই দলের ত্যাগী নেত্রী এবং কারাবরণ করেছেন। এদের অনেকের বিরুদ্ধে ১৫টিরও বেশি মামলা রয়েছে।

পদত্যাগের বিষয়টি স্বীকার করে মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ বলেন, রোববার রাতে পদত্যাগকারী নেত্রীরা আমার বাসায় এসেছিলেন। তারা শিশুর মতো কান্না করেছেন। ওদের কান্না দেখে আমিও আমার চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি।

তিনি বলেন, যারা পদত্যাগ করেছেন তারা পরীক্ষিত। সরকারি দলের হামলার শিকার হয়েছেন। বুকের শিশুকে বাসায় রেখে এসে আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবন্দি হয়েছেন। রক্তাক্ত হয়েছেন অনেকে। অথচ তারা পদত্যাগ করেছেন। খুব কষ্ট লাগছে।

নায়াব ইউসুফ বলেন,তারা ক্রাইম করবে পরে আবার কাঁদবে তা হবে না। জালিয়াতির কোনো ছাড় নেই। আগে স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়ে তদন্ত হবে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি দাবি করেন, সালমা, রোকেয়া, পান্না এবং তাহমিনা স্বাক্ষর জালিয়াতিতে জড়িত।

ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা দলের সদস্য সচিব রুনা লায়লা কান্নাজড়িত বলেন, আমি মর্মাহত। যারা পদত্যাগ করেছেন তারা হলেন রাজপথের বুলেটপ্রুফ। আমার পদবি না থাকলেও কষ্ট পেতাম না। একটি কর্মী তৈরি করা অনেক কঠিন। এরা ৩০টি বছর সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এরাই প্রথম মশাল মিছিল করেছে। প্রতিটি মেয়েই একাধিক মামলার আসামি। তারা চলে গেলে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিছু মানুষের একগুঁয়েমির কারণে মহিলা দল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যারা কর্মী তৈরিতে ভূমিকা রাখেনি তারা কর্মীর মূল্যায়ন কীভাবে বুঝবে?

১৬টি মামলার আসামি এবং ২৮ জুলাইয়ে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিতে মারাত্মক আহত হওয়া পদত্যাগকারী খিলক্ষেত থানা মহিলা দলের আহ্বায়ক পান্না ইয়াসমিন বলেন, ‘আমরা ছয়টি থানা একসঙ্গে পদত্যাগ করেছি। পদ-পদবি আল্লাহর দান, ভাগ্যে যদি থাকে তাহলে আবার রাজনীতিতে ফিরব ইনশাআল্লাহ। তবে মহানগর উত্তরের বর্তমান মহিলা দলের কমিটির অধীনে নয়। কারণ এই দুই নেত্রীর (আহ্বায়ক এবং সদস্য সচিব) রেষারেষির কারণে এবং এদের স্বাক্ষর স্বাক্ষর খেলা উত্তরের মহানগর আহ্বায়ক নায়াব ইউসুফ আপা খেলতে থাকুক। আমরাও দেখি কত খেলতে পারে। ওদের ইঁদুর-বিড়ালের খেলায় আমরা বঞ্চিত। এত মামলা, হামলা, পুলিশ লীগ এবং আওয়ামী লীগের মাইর ও অসুস্থতা নিয়ে ম্যাডাম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান এবং সুলতানা আপার নির্দেশে হাজারো প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে দলের সঙ্গে টিকে ছিলাম। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে মিটিং-মিছিলে উপস্থিত ছিলাম। এই তার পুরস্কার।

এদিকে শ্রমিক দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে এক দশকেরও বেশি সময়। দীর্ঘদিন সম্মেলন বা কমিটি পরিবর্তন না হওয়ায় অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে এ সংগঠনটি। যদিও বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী শামছুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের সার্বিক তত্ত্বাবধানে শ্রমিক দলকে চাঙ্গা করার কাজ অব্যাহত রয়েছে। তাঁতী দল দীর্ঘদিন আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে চললেও সংগঠনের ভেতরের একটি অংশ মূল নেতৃত্বের বিরোধিতা করে আসছেন। সেই অংশটি একাধিক সভাতে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটিয়েছেন। ছিঁড়ে ফেলেছেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের পোস্টার-ফেস্টুন। মহিলা দলের সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদকের সাথে বিরোধও বিএনপিতে ওপেন সিক্রেট। জাসাস একসময় শক্তিশালী সংগঠন হলেও বর্তমানে নেই কোনো কার্যক্রম।

 
Electronic Paper