ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ভাষা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা

লিটন ঘোষ জয়
🕐 ১১:২৯ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১

ভাষা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা

মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে সারা দেশের মতো মাগুরায়ও গড়ে উঠেছিল ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন। জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েন বায়ান্নর উত্তাল ভাষা আন্দোলনে। এজন্য কারাবরণও করতে হয়েছিল তাদের। মফস্বলের ভাষা সৈনিকদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ হলেও তারা আজও অবহেলিত। জোটেনি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও। ভাষার এই মাসে সকল ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মাগুরার কয়েকজন ভাষাসৈনিককে নিয়ে লিখেছেন লিটন ঘোষ জয়

মাগুরায় ভাষা আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন যারা
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে মাগুরায় যারা নেতৃত্ব দেন তাদের অধিকাংশই এখন আর বেঁচে নেই। তবে সে আন্দোলনে সামনে থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়া, সৈয়দ আতর আলী, হামিদুজ্জামান এহিয়া, জলিল খান, খান জিয়াউল হক, আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া, নুরুল ইসলাম, সৈয়দ মাহমুদ হাসান, আব্দুর রহিম জোয়ার্দ্দার, মির্জা শওকত হোসেন, সোহরাব হোসেন এবং আব্দুর রাশেদ। ভাষা আন্দোলনে সারা দেশের মতো মাগুরায়ও গড়ে উঠেছিল ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের ওপর পুলিশি গুলি বর্ষণের খবর যা আরও বেগবান হয়।

মাগুরায় ভাষা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেই সব পরিবারের দাবি এখনো বাংলা ভাষা উপযুক্ত মর্যাদা পায়নি। কেননা সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা এখনো পুরোপুরি চালু হয়নি। ফলে ভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ ও জেল জলুমের শিকার হয়েছিলেন তাদের সে ত্যাগ আজও পূর্ণতা পায়নি। ভাষা আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা নেওয়া এসব মানুষকে তেমন মূল্যায়িত হতে দেখা যায়নি। শহরের কোনো স্থাপনায় তাদের নামকরণ পর্যন্ত হয়নি। যে কারণে এসব পরিবারের দাবি তাদেরকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি যথাযথ মূল্যায়ন করা হোক।

গ্রামাঞ্চলেও ভাষা আন্দোলন বেগবান হয়েছিল
১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় যখন সভাসমাবেশ মিছিলসহ তুমুল আন্দোলন সংগ্রাম চলছিল তখন মাগুরার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সক্রিয় হয়ে উঠেছিল ছাত্রসমাজ। বেগবান হয়েছিল ভাষা আন্দোলন। তৎকালীন মহকুমা মাগুরার অধীন শ্রীপুর থানা এলাকায় নাকোল রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এমনকি পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে পড়ে রাইচরণ স্কুলের কয়েক ছাত্রকে কারাভোগও করতে হয়েছিল। এ ছাত্ররা হলেন, হামিদুজ্জামান এহিয়া, আব্দুর রাশেদ, সোহরাব হোসেন, জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ, আলী আহম্মদ মল্লিক ও মোকাদ্দেস মল্লিক। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা মিছিল বের করলে সে মিছিলে পাকিস্তানি শাসকদের বর্বরোচিত হামলায় ফুসে ওঠে সারা দেশ। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মির্জা শওকত হোসেন নিজ বাড়ি শ্রীপুরের নাকোল গ্রামে আসেন। তিনি এ এলাকায় ভাষা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করার জন্যে ছাত্রদের উজ্জীবিত করতে থাকেন। এ সময় তার কর্মতৎপরতায় শ্রীপুরসহ আশপাশ এলাকায় ভাষা আন্দোলন আরও গতিশীল হয়।

ভাষাসৈনিক নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়া
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে মাগুরায় যারা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়া। মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে তিনি গর্জে ওঠেন এবং জীবনবাজি রেখে তিনি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বায়ান্নর উত্তাল আন্দোলনের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশব্যাপী। মাগুরাও সে আন্দোলনের ফলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়া ছিলেন এ আন্দোলনের তরঙ্গশীর্ষে। ঢাকায় ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে মাগুরায় অনুষ্ঠিত প্রতিটি সভা সমাবেশের উদ্যোক্তা ও সংগঠক হিসাবে তিনি অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ সাল থেকে প্রতি বছর শহীদ দিবস পালনসহ বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রতিটি আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়া।

ভাষাসৈনিক সৈয়দ আতর আলী
সৈয়দ আতর আলী ১৯৪৯ সালে মাগুরা মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনে তিনি মাগুরার মানুষের সঙ্গে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছেন। তারপর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৮ ও ৯ নং সেক্টরের ‘পলিটিক্যাল কনভেনর’ হিসাবে তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ছাত্র-যুবসমাজকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে কাজ করেছেন প্রতিনিয়ত। বঙ্গবন্ধুর ১৯৬৬ সালের ৬ দফার দাবি বাস্তবায়নের জন্য বাইসাইকেলে তিনি জেলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে, হাটে-বাজারে মানুষের কাছে গিয়ে প্রচার করেছেন। ৬ দফার মূলকথাগুলো সাধারণ মানুষের উপযোগী ভাষায় ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি ভারতের বনগাঁয় বাংলাদেশ মিশনের একটি শাখার দায়িত্ব পালন করেছেন। সেখানে তিনি স্বাধীনতার জন্য মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। একজন সৎ, যোগ্য, দায়িত্বশীল ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন সৈয়দ আতর আলী। স্বাধীনতার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেও তিনি স্বাধীনতার লাল রক্তিম সূর্যটাকে দেখে যেতে পারেননি। এই দুর্লভ রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আতর আলী পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কল্যাণী জওহরলাল নেহেরু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর গভীর রাতে তিনি পরলোক গমন করেন। যশোর জেলার শার্শা থানার কাশিপুর গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ নূর মোহাম্মদের সঙ্গে ঘুমিয়ে আছেন এই নিঃলোভ মানুষটি। আমাদের গৌরবময় ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে সৈয়দ আতর আলীর অবদান মাগুরার মানুষ আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে আসছে।

ভাষাসৈনিক আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া
আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া সাহসী ভাষাসৈনিক। মাগুরায় সে সময় সামনে থেকে যারা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। তৎকালীন ছাত্রনেতা খান জিয়াউল হক ও চান্দু মিয়া, ভাষা আন্দোলনের সময় একসঙ্গে রাজপথে ছিলেন তারা, এমনকি একইসঙ্গে গ্রেফতারও হয়েছিলেন এই দুই বন্ধু। তখনো মাগুরায় তেমন কোনো আন্দোলন শুরু হয়নি। নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়া সংগঠিত করছিলেন এখানকার সবাইকে।

জানা যায়, আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া তখন বাম সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জিয়াউল হক মাগুরা এলে দু’বন্ধু মিলে আবু মিয়ার কাছে যায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঘটনা জানতে পেরে তিনি মাগুরার সংগঠক আবু মিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। পরদিন মিছিল নিয়ে এগিয়ে চৌরঙ্গী মোড়ে আসতেই পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সে সময় আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়ার সাহসিকতার কথা আজও মাগুরার আপামর মানুষ গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করে। ভাষাসৈনিক আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া বার্ধক্যজনিত কারণে মাগুরা সদর হাসপাতালে ১৪ এপ্রিল ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর।

বাঁশের তৈরি প্রথম শহীদ মিনার
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য মাগুরায় একাধিক স্থানে প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করা হয় বাঁশ দিয়ে। ঢাকার কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশনা অনুযায়ী এ শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। স্থানগুলো ছিল তৎকালীন মাগুরা মহকুমা শহরের ইসলামী ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, শ্রীপুরের এমসি পাইলট স্কুল, একই উপজেলার নাকোল রাইচরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শালিখার আড়পাড়া স্কুল, মহম্মদপুরের বিনোদপুর বসন্ত কুমার মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তৎকালীন মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জলিল খান, আব্দুর রহিম জোয়ারদার, নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়া, সৈয়দ আতর আলী, আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া, হামিদুজ্জামান এহিয়া, আজিম দেওয়ানসহ অন্য ছাত্রনেতারা এ কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন। একুশের প্রথম প্রহরে তারা নিজ নিজ এলাকায় বাঁশের তৈরি শহীদ মিনার তৈরি করে সেখানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সে সময় মাগুরার এ ছাত্রনেতাদের নানা কার্যক্রম সমন্বয় করতেন শ্রীপুরের নাকোল গ্রামের বাসিন্দা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা মির্জা শওকত। ঢাকা থেকে একাধিকবার মাগুরাতে এসে তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছাত্রদের নানাভাবে সংগঠিত করতেন বলে জানা যায়।

জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
মাগুরায় প্রথম কংক্রিটের শহীদ মিনার নির্মাণ হয় ১৯৫৪ সালে। মাগুরার তৎকালীন ইসলামী ইন্টারমিডিয়েট (বর্তমান সরকারি হোসেন সোহরাওয়ার্দী) কলেজ চত্বরে। এটি নির্মাণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা মাগুরা পারন্দুয়ালি গ্রামের গোলাম মওলা। স্থানটি ছিল বর্তমান সরকারি কলেজের উত্তর পূর্বকোণে। কিন্তু রাতের আঁধারে এটি দুর্বৃত্তরা ভেঙে দেয়। ১৯৬৮ সালে আরও একটি শহীদ মিনার নির্মিত হয়। সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের যে স্থানে বর্তমানে শহীদ মিনার স্থাপিত তার দক্ষিণ দিকে এ কলেজের তৎকালীন ছাত্রসংসদ নেতাদের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল এটি। বর্তমানে সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের যে শহীদ মিনারটি জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসেবে চিহ্নিত- এটি নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় লাভের পর পরই। আর এটি হচ্ছে মাগুরা জেলার অন্যতম শহীদ মিনার। যা মাগুরার আপামর মানুষের কাছে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসেবে পরিচিত।

এ কেএম হামিদুজ্জামান এহিয়া
মৃত্যুর কিছুদিন আগে তার এই স্মৃতিচারণ

“ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি আমাকে এখনো সাহসী করে। আমার ব্যক্তিগত জীবনেরও নানা সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের শক্তি জোগায়। ভাষা আন্দোলনের অনন্য চেতনায় আমি এখনো উদ্দীপ্ত। এটা আমার অহংকার। যে বয়সে মানুষ যাবতীয় বাধাকে অতিক্রম করতে পারে। যে বয়সে মানুষ তার কর্মপ্রবাহ দিয়ে ইতিহাস গড়তে পারে সে বয়সে আমিও যুক্ত হতে পেরেছিলাম মহান ভাষা আন্দোলনে। যা আমাকে সবসময় গৌরবান্বিত করে। ২০০১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজকের কাগজে আমার ওপর একটি ফিচার প্রকাশিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনে আমার ভূমিকার কথার পাশাপাশি আমার বক্তব্য প্রকাশ করেছিল। আমি বলেছিলাম ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে বাঙালি জাতি যুক্ত হয়। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাসে অনন্য মহিমায় উৎকীর্ণ। ভাষা আন্দোলনে যুক্ত আমরা সুন্দর দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম।

কিন্তু কিছু শ্রেণি বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। তারা একটি মিশ্র সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে উঠছে। জন্মগতভাবে বাঙালি হলেও বিদেশি ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর ঝুকে পড়ছে। অনুকরণ করছে। বিপথগামী এই প্রজন্মকে দেখে আমি সত্যিই হতাশ হই। বেদনার্ত হই।
একুশ এলেই আমি এই প্রৌঢ় জীবন ছেড়ে যেন ফিরে যাই সুদূর অতীতে। আমি তখন স্কুলগামী ছাত্র। তবুও আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার পরিপক্কতা এখনকার ছেলে-মেয়েদের থেকে অনেক বেশি ছিল। ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কারণে আমি যখন গ্রেফতার হই। তখন বয়সিক বিবেচনায় আমার খুব বেশি বয়স নয়। তখন আমার বয়স মাত্র ষোল বছর। কিন্তু আমাদের মধ্যে অধিকারের বোধটা সেই প্রেক্ষাপটে প্রবল ছিল। মাতৃভাষায় কথা বলব এটা আমাদের জন্মগত অধিকার। এই সহজ কথাটা বুঝতে কঠিন মনে হতো না। বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ওপর নৃশংস গুলি বর্ষণের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল থেকে মির্জা শওকত হোসেনের নেতৃত্বে একদল ছাত্র আমাদের গ্রাম মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার নাকোলে এসে আমাদের নিয়ে সভা সমাবেশ করে। সেই থেকে আমি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় যুক্ত হয়ে পড়ি।

আমি আমার সহপাঠী বন্ধুদের নিয়ে মাগুরা হাইস্কুল, নাকোল রাইচরন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শ্রীপুর হাইস্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভা সমাবেশ, মিছিল, লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। আমাদের মিছিলে আমাদের মুহুর্মুহু স্লোগানে আমার কণ্ঠের সঙ্গে অগণিত ছাত্রকণ্ঠের মিলিত ধ্বনি দিগন্তকে প্রকম্পিত করত।

শুধু আমার সহপাঠী বন্ধুরাই নয়। তখনকার শ্রীপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক জোয়ার্দার আব্দুর রহিমের কথা আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। আমি কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতাদের আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পেরেছিলাম।
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হতে পারা। এই অর্জনের কারণে আমি জননেতা গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য ও আশীর্বাদ লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমি আমৃত্যু বলতে চাই ভাষা আন্দোলনই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। ভাষা আন্দোলনই আমার জীবনের অনন্য স্মৃতি। এই স্মৃতিই আমার মূলশক্তি। প্রধান প্রেরণা।”
হামিদুজ্জামান এহিয়া ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে ১৯৫৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বেলুচ আর্মড ফোর্সের হাতে গ্রেফতার হন। এ সময় তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। এই ঘটনার কারণে নাকোল রাইচরন মাধমিক বিদ্যালয় থেকে তার ছাত্রত্ব বাতিল হয়ে যায়।

সি এম তারেক রেজার ‘একুশ, ভাষা আন্দোলনের সচিত্র ইতিহাস’ গ্রন্থে একটি পাতার লাবণ্যবর্ধন করেছে তার নাম আলোকচিত্র। ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য মাগুরার একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে “ভাষাসৈনিক হামিদুজ্জামান এহিয়া সড়ক”, (কেষ্টপুর বিশ্বরোড হতে নাকোল বাজারে গিয়ে মিশেছে)। ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও মিউজিয়াম তাকে সম্মাননায় ভূষিত করেছে। এ ছাড়াও তিনি অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন। ভাষাসৈনিক হামিদুজ্জামান ২০০৬ সালের ১৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন।

খান জিয়াউল হক এর স্মৃতিচারণ...

মাগুরার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ভাষাসৈনিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক খান জিয়াউল হক ১৯৫০ সালে যশোর এমএম কলেজের ছাত্র সংসদের সভাপতি নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। দেশব্যাপী ভাষা আন্দোলনের সময় খুলনার আন্দোলনেও ভূমিকা রাখেন তিনি।

ভাষা আন্দোলন নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে খান জিয়াউল হক (৯৩), কবি ও সাংবাদিক লিটন ঘোষ জয়কে জানান, ‘১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেওয়ার কারণে তৎকালীন মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। যেহেতু মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলাম। তাই মুসলিম লীগ নেতারা আমাকে ভাষা আন্দোলন থেকে সরে যেতে বলেন। বাধ্য হয়ে মুসলিম ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করি, এরপর সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে মিছিলে যোগ দিই আমি। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এবং পুলিশের বাধার কারণে একসময় নিজ বাড়ি মাগুরায় চলে আসি। তখনো মাগুরায় তেমন কোনো আন্দোলন শুরু হয়নি। নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়া সংঘবদ্ধ করছিলেন সবাইকে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ঘটনা জানতে পেরে আমি ও আমিনুল ইসলাম চান্দু মিয়া মাগুরার সংগঠক নাসিরুল ইসলাম আবু মিয়ার সঙ্গে দেখা করি। সেখান থেকেই ঠিক করা হয় যে, পরদিনই মিছিল ও সমাবেশ করা হবে। সেদিন সকালেই সবাই সেগুন বাগিচায় একত্রিত হই। সেখানে আবু মিয়ার সভাপতিত্বে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে আমরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে চৌরঙ্গী মোড়ে আসতেই পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। অন্যরা নিরাপদ স্থানে সরে গেলেও আমি, জলিল খান এবং চান্দু মিয়া পুলিশের হাতে ধরা পড়ি। আমাদেরকে আটকে রাখে। বিকালে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ সময় বাইরে মির্জা শওকত এবং আজিম দেওয়ান অন্যদেরকে সঙ্গে নিয়ে বিক্ষোভ করে।’

কথা প্রসঙ্গে খান জিয়াউল হক জানান, ‘নতুন প্রজন্ম ভাষা সৈনিকদের গুরুত্ব দিচ্ছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে যেমন সমাহিত করা হয় তেমনি ভাষাসৈনিকদেরও করা হোক। আর সঠিক ইতিহাস রক্ষার স্বার্থে ভাষাসৈনিকদের প্রকৃত তালিকা করা জরুরি। জীবনে যা পেয়েছি তা অনেক। তবে একটাই আক্ষেপ। আজ পর্যন্ত ভাষাসৈনিকদের কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি (সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত) দেওয়া হলো না।’ এ আক্ষেপ মাগুরার একমাত্র জীবিত ভাষাসৈনিক খান জিয়াউল হকের।

তথ্যসূত্র ও ঋণস্বীকার

“একুশ” সি এম তারেক রেজা, (ভাষা আন্দোলনের সচিত্র ইতিহাস- ১৯৪৭-১৯৫৬)।
“ভাষা সংগ্রামের স্মৃতি” সম্পাদনায় : এম আর মাহবুব।
“যারা অমর ভাষা সংগ্রামে” এম আর মাহবুব।
ভাষাসৈনিক হামিদুজ্জামানের কথা, এম আর মাহবুব, (ভাষা আন্দোলন বিষয়ক গবেষক)।
মাগুরার ইতিহাস গবেষক ডা. কাজী তাসুকুজ্জামান
ভাষা আন্দোলনের জন্য ত্যাগ, মাজহারুল হক লিপু, (মাগুরা বাংলা ট্রিবিউন ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)।
সাগর জামান, কবি ও প্রাবন্ধিক (ভাষাসৈনিক হামিদুজ্জামানের সন্তান)।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper