বাবার মৃত্যুর ৯ ঘন্টা পর মেয়ের জন্ম
৯ ঘন্টার ব্যবধানে দেখা হয়নি বাবা-মেয়ের
এম. মনছুর আলম, চকরিয়া
🕐 ৮:৪২ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০২৩

পৃথিবীর বুকে আকস্মিকভাবে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা মানুষের হৃদয়কে খুবই নাড়া দেয়। যা চোখে না দেখলে কখনও কারো বিশ্বাসও হবে না। সত্যিই বিধাতার কি নিয়তি! কক্সবাজারের চকরিয়ায় একটি পরিবারের মাঝে এমন এক হৃদয়স্পর্শী ও করুণ ঘটনার সৃষ্টি হয় যা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। বলেছিলাম মরণব্যাধী ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া টগবগে যুবক শাহজাহান মনির ও তার পরিবারের কথা।
বৃহস্পতিবার রাত সোয়া নয়টায় চকরিয়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি শাহজাহান মনির ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। পরের দিন শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে দক্ষিণ লক্ষ্যারচর সিকদার পাড়া কেন্দ্রীয় জামে মসজিদসংলগ্ন মাঠে তাঁর জানাজা নামায শেষে দাফন সম্পন্ন হয়।
দাফনপর্ব শেষ হলেও প্রিয় সন্তান হারানো মায়ের মনে জমে আছে শোকের মেঘ। কথা বেরোনোর আগেই বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন তার গর্ভধারণী মা। পরিবারের সদস্যদের সামনে মুহুর্তেই অকালে ঝরে যাওয়া শাহজাহানের মুখ ভেসে ওঠে ভাই-বোনের চোখের সামনে। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা যেতে না যেতেই শাহজাহানের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নেওয়া হয় হাসপাতালে।
শাহজাহানের দাফনের সাড়ে আট ঘণ্টা পর ওইদিন রাত সাড়ে আটটায় চকরিয়া পৌরশহরের ম্যাক্স হাসপাতালে তার স্ত্রী রুশনি জান্নাত ফুটফুটে এক কন্যা শিশুর জন্ম দেন। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে বাবা দেখতে পেলেন না সদ্য জন্ম নেওয়া আদরের প্রিয় সন্তানকে আর মেয়ের দেখা হলো না তার জন্মদাতা বাবাকে। ফুটফুটে জন্ম নেওয়া কন্যা শিশুটি চিরদিনের জন্য হারিয়েছে তার বাবাকে। তাও আবার মাত্র ৯ ঘন্টার ব্যবধানে। শুধু এতিমই হয়নি শিশুটি, অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার ভবিষ্যতও। সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া কন্যা ছাড়াও শাহজাহান মনিরের ঘরে সানজিদা হক রাফা নামের প্রায় আড়াই বছর বয়সী আরেকটি মেয়ে শিশু রয়েছে।
এমন হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ঘটেছে চকরিয়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তরছ পাড়া গ্রামে।
জানাগেছে, শাহজাহান মনির ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারী পৌরসভা তিন নম্বর ওয়ার্ডের এস কে পাড়া এলাকার রুশনি জন্নাতের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিধাতার কি আজব লীলাখেলা! তার লাশ দাফনও করা হয়েছে একই তারিখে। আবার একই তারিখেই শাহজাহান মনিরের দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয়। সে রাজনীতির পাশাপাশি তার এলাকায় ফার্নিচারের ব্যবসার দোকান করেন। আট ভাই-বোনের মধ্যে শাহজাহান মনির পরিবারের তৃতীয় সন্তান।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। শাহজাহান মনির চকরিয়া কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চকরিয়া পৌরসভা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চকরিয়া পৌরসভা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মৃত্যুর পূর্বে মুহুর্ত পর্যন্ত চকরিয়া পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
শাহজাহান মনিরের বাল্যবন্ধু ও তিন নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. মঈনু উদ্দিন জানান, বিগত পাঁচ মাস আগে শাহজাহান মনিরের লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে। চট্টগ্রামে কয়েক দিন চিকিৎসা করার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের হায়দরাবাদের এআইজি হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকেরা তাকে কেমোথেরাপি দেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে দেশে ফিরে চট্টগ্রামের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা: আবদুল আউয়ালের তত্ত্বাবধানে ছয়টি কেমোথেরাপি নেন তিনি। তবে অবস্থার অবনতি হলে শাহজাহানকে পুনরায় ভারতের হায়দরাবাদ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে সেখানকার চিকিৎসকদের পরামর্শে গত মঙ্গলবার শাহজাহান দেশে ফেরেন।
তিনি আরও বলেন, বাল্যবন্ধু শাহজাহান মনির ছিলেন সদাহাস্যেজ্জ্বল, অত্যন্ত পরোপকারী ও মিষ্টিভাষী। রাজনীতি করলেও কারও সাথে ব্যক্তিগত কোন ধরণের বিরোধ ছিল না। সে সকলস্তরের মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন।
তার ক্যান্সার আক্রান্তের খবরে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে অনেকে সহযোগিতা-সহমর্মিতা জানায়। তিনি অল্প সময়ে সবাইকে কাঁদিয়ে পরপারে চলে গেলেন। বন্ধু শাহজাহান ও তার সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া কন্যার জন্য সবার কাছে দোয়া প্রত্যাশা রাখি।
শাহজাহান মনিরের বৃদ্ধ মা বিলাপ করে বলেন, তার ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর এখন কি হবে-বলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। আমার ছোট ছোট নাতনিরা বুঝতে শেখার আগেই এতিম হলো। এই শোক আমি কিভাবে সইবো। শাহজাহানের চিকিৎসার পেছনেও অনেক টাকা খরচ হয়েছে। এখন কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
