ব্রাজিলের বেলেমে চলমান বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন কপ-৩০। এর স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা নতুন আলোয় জমেছে।কিন্তু অর্ধেক পথ পেরোতেই দেখা দিচ্ছে কঠিন বাস্তবতা, নেই প্রত্যাশিত অগ্রগতি,বহুল প্রতিশ্রুতি সমন্বিত উচ্চাভিলাষ। ব্রাজিলের বেলেমে প্রতিদিন যেমন বৃষ্টি ঝরে, তেমনি ঝরে হাজারো প্রতিশ্রুতিমালা।
উন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করে ঠিকই। কিন্তু তাদের দৃঢ়তার চেয়ে কূটনৈতিক জটিলতার রেশই বেশি। অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো তাকিয়ে থাকে এ সম্মেলনের দিকে তাদের শেষ আশ্রয়, শেষ সুযোগ ভেবে।
বেলেমের সম্মেলন কেন্দ্রে কনভেনশন সেন্টারের বাইরে হাজারো মানুষের স্লোগানে যেন অন্য এক সত্য ফুটে উঠছে। শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের প্রভাব ও স্বার্থের অঙ্কে ব্যস্ত। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, উচ্চতা দিনদিন বাড়ছে, কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ঠিক সেভাবেই পিছিয়ে যাচ্ছে। অভিযোজন তহবিল বৃদ্ধি, সহজ শর্তের ঋণ, প্রযুক্তির ন্যায্য প্রাপ্তি আলোচনায় এসব দাবি আজও উপেক্ষিত।
নিম্ন–আয়ের ও জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো দ্রুত ঋণফাঁদে আটকে যাচ্ছে—এমন সতর্কতা দিয়েছে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ ও ইয়ুথ পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (YPSA)। সংস্থাদ্বয় যৌথভাবে প্রকাশিত ক্লাইমেট ডেট রিস্ক ইনডেক্স ঋণভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়ন, দীর্ঘসূত্রিতায় অর্থ ছাড় এবং ঘনঘন জলবায়ু বিপর্যয়ের সম্মিলিত প্রভাবে।
সংস্থাদ্বয় যৌথভাবে প্রকাশিত ক্লাইমেট ডেট রিস্ক ইনডেক্স ২০২৫ (CDRI’25)–এ ৫৫টি দেশের ঝুঁকিস্তর পরিমাপ করা হয়েছে।
ঝুঁকির চিত্র: ৫৫ দেশের মধ্যে ৪৭ দেশ উচ্চ ঝুঁকিতে
সূচক বলছে:
১৩ দেশ “অতি উচ্চ ঝুঁকি”
৩৪ দেশ “উচ্চ ঝুঁকি”
৬ দেশ “মাঝারি ঝুঁকি”
মাত্র ২ দেশ “নিম্ন ঝুঁকি”
সাহেল অঞ্চল, পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলীয় দেশ, কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র (SIDS) এবং দক্ষিণ এশিয়ার কিছু বৃহৎ অর্থনীতি ঋণনির্ভর জলবায়ু অর্থায়নের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।
২০২৮ সালে জিবুতি ও গিনি “অতি উচ্চ ঝুঁকি”তে উঠে আসে; তিমুর-লেস্তে “মাঝারি” থেকে “উচ্চ” ঝুঁকিতে যায়। প্রক্ষেপণ বলছে—২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ, জিবুতি, লাইবেরিয়া ও উগান্ডা অতি উচ্চ ঝুঁকিতে চলে যেতে পারে, যদি অর্থায়ন ব্যবস্থা অপরিবর্তিত থাকবে।
জলবায়ু ঋণভার: দিচ্ছে বেশি, পাচ্ছে কম
২০২৩ সালে এই ৫৫ দেশ ঋণ শোধে ব্যয় করেছে ৪৭.১৭ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু জলবায়ু কর্মে পেয়েছে মাত্র ৩৩.৭৪ বিলিয়ন ডলার।
প্রতি নাগরিকের গড়ে ২৩.১২ ডলার জলবায়ু-লেবেলযুক্ত সরকারি ঋণ আছে।
এটি—দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ: ২৯.৮৭ ডলার
পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত অঞ্চলে: ২৩.৫৮ ডলার
সাব-সাহারা আফ্রিকায়: ২১.৬১ ডলার
কাবো ভার্দে, নাইজার, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ এবং বাংলাদেশে জলবায়ু ঋণের অনুপাত দ্রুত বাড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে “জলবায়ু-ঋণ নির্ভরতা” তৈরি করছে।
জলবায়ু সম্মেলন কপ-৩০। স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার নতুন আলোয়।
বেলেমের আকাশে প্রতিদিন উন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করে ঠিকই। কিন্তু তাদের কণ্ঠে দৃঢ়তার চেয়ে কূটনৈতিক জটিলতার রেশই বেশি। অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো তাকিয়ে আছে এ সম্মেলনকে তাদের শেষ আশ্রয়, শেষ সুযোগ ভেবে।
বেলেমের কনভেনশন সেন্টারের বাইরে হাজারো মানুষের স্লোগানে গানে যেন অন্য এক সত্য ফুটে উঠছে আমরা সময় হারাচ্ছি। শক্তিশালী দেশগুলো নিজেদের প্রভাব ও স্বার্থের অঙ্কে ব্যস্ত। বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে উচ্চতা দিন-দিন যেভাবে বাড়ছে, কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ঠিক সেভাবেই পিছিয়ে যাচ্ছে। অভিযোজন তহবিল বৃদ্ধি, সহজ শর্তের ঋণ, প্রযুক্তির ন্যায্য প্রাপ্তি আলোচনায় এসব দাবি আজও উপেক্ষিত।
অর্ধেক পথ পেরিয়ে কপ-৩০ যেন এমন এক সম্মেলনে পরিণত হয়েছে, যার ভেতরে সময়ের চাকা ঘুরছে খুব ধীরে। আলোচনার জট, বিভাজন, রাজনৈতিক টানাপড়েন সব মিলিয়ে ‘অগ্রগতির সম্ভাবনা’ দিনে দিনে ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে সম্মেলনস্থলের মূল প্রবেশদ্বারে শান্তিপূর্ণ অবস্থান করে আমাজন অঞ্চলের আদিবাসী মুণ্ডুরুকু সম্প্রদায় কপ-৩০ সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগোর সঙ্গে জরুরি বৈঠকের দাবি তোলে। আমাজনের প্রায় ২৪ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাসরত এ জনগোষ্ঠীর দাবি, ‘আমরাই জলবায়ুর প্রকৃত রক্ষক; আমাজনকে আর ধ্বংসের পথে এগোতে দেওয়া যাবে না।’ পরে কপ-৩০ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে আদিবাসী প্রতিনিধিরা প্রশ্ন তোলেন, যদি আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ না করা হয়, তবে তাঁদের কেন বেলেমে আনা হলো? কপ-৩০ সভাপতি দো লাগো প্রতিশ্রুতি দেন, তাঁদের জন্য বাড়তি কনফারেন্স পাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তেল-গ্যাসসহ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে ‘ধীরে ধীরে সরে আসার’ প্রতিশ্রুতি কপ-২৮ এ দেওয়া হলেও তা এবার আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচিতে না থাকায় অনেকেই শঙ্কিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত দেশগুলো শত শত সদস্য নিয়ে আলোচনায় অংশ নিলেও অনেক স্বল্পোন্নত দেশ দুই-তিনজন প্রতিনিধিকে নিয়ে বৈশ্বিক আলোচনার ‘জটিল দাবার গুটি’ সামলাতে হিমশিম খায়। ফলে সিদ্ধান্ত প্রভাবিত হয় শক্তিধর দেশগুলোর পক্ষে।
সমালোচকরা বলেছেন, ফলপ্রসূ সমাধানের চেয়ে লবিস্টদের উপস্থিতি ও জটিল আমলাতান্ত্রিক কাঠামো জলবায়ু সম্মেলনকে কার্যত বার্ষিক ‘বাণিজ্য মেলায়’ পরিণত করছে। সম্মেলনে যে পরিমাণ জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির লবিস্ট অংশ নিচ্ছেন, তা বহু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সম্মিলিত প্রতিনিধির চাইতেও বেশি।
কপ-৩১ আয়োজন নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও তুরস্কের বিরোধও জমে উঠেছে। দুটি দেশই ২০২২ সালে আবেদন করেছিল এবং এখনো কেউ সরে দাঁড়াতে সম্মত নয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র তিন দশকের ইতিহাসে এবারই প্রথম উচ্চপর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধিদল পাঠায়নি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ায় কপ-৩০এ দেশটির অনুপস্থিতি স্পষ্ট। এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে এসেছে চীন। দেশটির প্রতিনিধিরা বলেছেন, তাঁদের নবায়নযোগ্য শক্তির নেতৃত দক্ষিণের দেশগুলোকে শক্তিশালী করছে। চীনা কূটনীতিকরা এবার পর্দার আড়ালেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। আলোচনার শুরুতেই এজেন্ডা চূড়ান্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় বেইজিং, যা আগের কপগুলোতে দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃহত্তর নেতৃত্ব দেখাতে হলে চীনকে আরও উচ্চাভিলাষী নির্গমন কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
কপ-৩০ এর শেষ সপ্তাহে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার জন্য নতুন মন্ত্রীপর্যায়ের জুটি ঘোষণা করা হয়েছে। জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন, প্রশমন, প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা এগিয়ে নিতে এসব জুটি আলোচনায় নেতৃত্ব দেবেন। প্রেসিডেন্সি সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাজ্য ও কেনিয়া একসঙ্গে কাজ করবে জলবায়ু অর্থায়ন ইস্যুতে। গাম্বিয়া ও জার্মানি দায়িত্ব পেয়েছে অভিযোজন আলোচনার। মিশর ও স্পেন নেতৃত্ব দেবে প্রশমন বিষয়ে। এ ছাড়া বৈশ্বিক পর্যালোচনার দায়িত্ব পেয়েছে নরওয়ে ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর নিয়ে কাজ করবে মেক্সিকো ও পোল্যান্ড। আর প্রযুক্তি হস্তান্তর আলোচনায় নেতৃত্ব দেবে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত।
জলবায়ু আলোচনায় বিভিন্ন ইস্যুতে এখনও বিভাজন রয়ে গেছে। তবে ইতিবাচক দিক হলো, ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে একটি রোডম্যাপ তৈরির পক্ষে সমর্থন দিন-দিন বাড়ছে। এদিকে স্বাগতিক ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা আলোচনার শুরুতেই এক অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি ‘কল অব বেলেম ফর দ্য ক্লাইমেট’ নামে একটি রাজনৈতিক আহ্বানপত্র প্রকাশ করেন। এতে তিনি দেশগুলোকে আহ্বান জানান- অভিযোজন তহবিল উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে হবে, প্রয়োজনে বর্তমান তহবিল তিনগুণ পর্যন্ত বাড়াতে হবে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্বলতা কমানো এবং জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলার জরুরি প্রয়োজন বিবেচনায় অনুদানভিত্তিক এবং সহজ শর্তের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
কপ-৩০ এখন প্রবেশ করেছে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে। জটিল অবস্থান, রাজনৈতিক টানাপড়েন এবং ধীর আলোচনার ছন্দ সত্ত্বেও বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা- শেষ সপ্তাহে ফের আলো জ্বলে উঠবে। দেশগুলো উচ্চাভিলাষ বাড়াবে, মানুষের বাঁচার দাবিকে প্রাধান্য দেবে এবং পৃথিবীকে রক্ষার পথ দেখাবে।
বেলেমে চলমান কপ৩০-এর ষষ্ঠ দিনে গতকাল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল জলবায়ু রূপান্তরের জন্য বৈশ্বিক অর্থায়ন জোরদার করা। এ দিন উচ্চপর্যায়ের সভা, ঘোষণাপত্র ও আলোচনায় উঠে এসেছে ন্যায়সংগত রূপান্তর নিশ্চিত করতে আর্থিক কাঠামো শক্তিশালী করার বিষয়টি।
দিনের শুরুতেই ইন্টিগ্রেটেড ফোরাম অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ট্রেডের উদ্বোধন হয়। এ ফোরাম জলবায়ু উচ্চাকাক্সক্ষার সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি ট্যাক্সোনমি ইন্টারঅপারেবিলিটি সেশনে দেখানো হয়- বিশ্বব্যাপী টেকসই অর্থায়নের মান ও কাঠামোকে একীভূত করা গেলে উদীয়মান অর্থনীতিতে বিনিয়োগ প্রবাহ বহুগুণ বাড়তে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রাজিল ও গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড একযোগে নতুন কান্ট্রি প্ল্যাটফর্ম এবং সাউথ-সাউথ নলেজ হাব চালুর ঘোষণা দেয়। এসব উদ্যোগ আঞ্চলিক সহযোগিতা, বিনিয়োগ পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান বিনিময়কে আরো শক্তিশালী করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
দুপুরে অনুষ্ঠিত হয় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিপর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠক। সেখানে উঠে আসে প্রিমিয়াম এয়ার ট্রাভেলের ওপর ‘সলিডারিটি লেভি’ আরোপের প্রস্তাব। জলবায়ু অভিযোজন, ক্ষতি-ক্ষয়ক্ষতির তহবিল ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে এটি হতে পারে নতুন এক বড় অর্থের উৎস। বৈঠকে উন্মোচন করা হয় ‘দ্য আনট্যাপড পটেনশিয়াল অব সলিডারিটি লেভিজ’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের মূল সুপারিশও।
দিনের অন্যতম আলোচিত আয়োজন ছিল বাকু টু বেলেম রোডম্যাপ টু ১.৩ ট্রিলিয়নের ওপর উচ্চপর্যায়ের ইভেন্ট। এখানে কপ৩০ সার্কেল অব ফাইন্যান্স মিনিস্টার্স রিপোর্টের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের পথনকশা নিয়ে মতবিনিময় হয়। বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবছর ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়ন কীভাবে সংগ্রহ করা যায়, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
এ ছাড়া ওপেন কোয়ালিশন অন কমপ্লায়েন্স কার্বন মার্কেটস বৈঠকে বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান কার্বন বাজারের মান, মূল্য নির্ধারণ এবং সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে অভিন্ন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
দিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সেশন ছিল সুপার পলিউট্যান্টস : দ্য ওয়ার্ল্ডস ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি ব্রেক শীর্ষক অনুষ্ঠান। এতে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে কীভাবে স্বল্প ব্যয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায়, তা তুলে ধরে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা।
দিনের শেষে কপ, সিএমপি ও সিএমএর যৌথ প্ল্যানারি বৈঠকে এসবি৬৩-এর রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয়।
সার্বিক আলোচনা স্পষ্ট করেছে- আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কার, ন্যায়সংগত সহযোগিতা এবং যৌথ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া জলবায়ু রূপান্তরের পথ স্থায়ী ও টেকসই হবে না।
ব্রাজিলের বেলেম শহরে জাতিসংঘ কপ৩০ জলবায়ু সম্মেলনের প্রধান প্রবেশপথ অবরোধ করেছে আদিবাসী বিক্ষোভকারীরা। অবরোধ কর্মসূচিতে প্রায় ৬০ জন বিক্ষোভকারী অংশ নেয়। তাদের অধিকাংশ ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও মাথার অলংকার পরিহিত ছিলেন। তারা প্রধান প্রবেশপথ এবং সংলগ্ন একটি সড়ক অবরোধ করেন বলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত এএফপি সাংবাদিকরা জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের জলবায়ু আলোচনায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কয়েক হাজারে পৌঁছেছে। তাদেরকে সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে থাকা একটি চেকপয়েন্ট অতিক্রম করে পাশের প্রবেশপথ দিয়ে প্রবেশ করতে বলা হয়। জাতিসংঘের জলবায়ু সংস্থা অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে বার্তায় জানায়, এই ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে কোনো ঝুঁকি নেই’।
আমাজন অঞ্চলে বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের বিরুদ্ধে মুণ্ডুরুকু আদিবাসীর এক বিক্ষোভকারীর হাতে থাকা ব্যানারে লেখা ছিল, ‘আমাদের ভূমির জন্য লড়াই মানে আমাদের জীবনের জন্য লড়াই’। বিক্ষোভকারীরা ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার সঙ্গে বৈঠকের দাবি জানান। তিনি আমাজন সীমান্তবর্তী বেলেমে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন।
বৃহস্পতিবার ব্রাজিল কপ৩০-এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেয়। সপ্তাহের শুরুর দিকে আদিবাসী উপজাতির সদস্যদের একটি পৃথক বিক্ষোভ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আদিবাসী বিক্ষোভকারী ও তাদের সমর্থকরা আলোচনার স্থান দখল করে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন—যা জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে খুব কমই দেখা যায়।
কপ৩০-এর সভাপতি আন্দ্রে কোরেয়া দো লাগো বেলেমে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বলেন, ‘কোনো প্রয়োজন নেই, এটি আসলেই একটি ছোটখাটো ঘটনা ছিল।
কপ-৩১ আয়োজন নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও তুরস্কের বিরোধও জমে উঠেছে। দুটি দেশই ২০২২ সালে আবেদন করেছিল এবং এখনো কেউ সরে দাঁড়াতে সম্মত নয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র তিন দশকের ইতিহাসে এবারই প্রথম উচ্চপর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধিদল পাঠায়নি। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেওয়ায় কপ-৩০এ দেশটির অনুপস্থিতি স্পষ্ট। এই শূন্যস্থান পূরণে এগিয়ে এসেছে চীন। দেশটির প্রতিনিধিরা বলেছেন, তাঁদের নবায়নযোগ্য শক্তির নেতৃত দক্ষিণের দেশগুলোকে শক্তিশালী করছে। চীনা কূটনীতিকরা এবার পর্দার আড়ালেও সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। আলোচনার শুরুতেই এজেন্ডা চূড়ান্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় বেইজিং, যা আগের কপগুলোতে দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃহত্তর নেতৃত্ব দেখাতে হলে চীনকে আরো উচ্চাভিলাষী নির্গমন কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে।
কপ-৩০ এর শেষ সপ্তাহে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার জন্য নতুন মন্ত্রীপর্যায়ের জুটি ঘোষণা করা হয়েছে। জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন, প্রশমন, প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা এগিয়ে নিতে এসব জুটি আলোচনায় নেতৃত্ব দেবেন। প্রেসিডেন্সি সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাজ্য ও কেনিয়া একসঙ্গে কাজ করবে জলবায়ু অর্থায়ন ইস্যুতে। গাম্বিয়া ও জার্মানি দায়িত্ব পেয়েছে অভিযোজন আলোচনার। মিশর ও স্পেন নেতৃত্ব দেবে প্রশমন বিষয়ে। এ ছাড়া বৈশ্বিক পর্যালোচনার দায়িত্ব পেয়েছে নরওয়ে ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর নিয়ে কাজ করবে মেক্সিকো ও পোল্যান্ড। আর প্রযুক্তি হস্তান্তর আলোচনায় নেতৃত্ব দেবে অস্ট্রেলিয়া ও ভারত।
জলবায়ু আলোচনায় বিভিন্ন ইস্যুতে এখনও বিভাজন রয়ে গেছে। তবে ইতিবাচক দিক হলো, ১.৫ ডিগ্রি লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে একটি রোডম্যাপ তৈরির পক্ষে সমর্থন দিন-দিন বাড়ছে। এদিকে স্বাগতিক ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা আলোচনার শুরুতেই এক অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি ‘কল অব বেলেম ফর দ্য ক্লাইমেট’ নামে একটি রাজনৈতিক আহ্বানপত্র প্রকাশ করেন। এতে তিনি দেশগুলোকে আহ্বান জানান- অভিযোজন তহবিল উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে হবে, প্রয়োজনে বর্তমান তহবিল তিনগুণ পর্যন্ত বাড়াতে হবে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্বলতা কমানো এবং জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলার জরুরি প্রয়োজন বিবেচনায় অনুদানভিত্তিক এবং সহজ শর্তের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
কপ-৩০ এখন প্রবেশ করেছে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে। জটিল অবস্থান, রাজনৈতিক টানাপড়েন এবং ধীর আলোচনার ছন্দ সত্ত্বেও বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা শেষ সপ্তাহে ফের আলো জ্বলে উঠবে। দেশগুলো উচ্চাভিলাষ বাড়াবে, মানুষের বাঁচার দাবিকে প্রাধান্য দেবে এবং পৃথিবীকে রক্ষার পথ দেখাবে।
বেলেমে চলমান কপ৩০-এর ষষ্ঠ দিনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল জলবায়ু রূপান্তরের জন্য বৈশ্বিক অর্থায়ন জোরদার করা। এ দিন উচ্চপর্যায়ের সভা, ঘোষণাপত্র ও আলোচনায় উঠে এসেছে ন্যায়সংগত রূপান্তর নিশ্চিত করতে আর্থিক কাঠামো শক্তিশালী করার বিষয়টি।
দিনের শুরুতেই ইন্টিগ্রেটেড ফোরাম অন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ট্রেডের উদ্বোধন হয়। এ ফোরাম জলবায়ু উচ্চাকাক্সক্ষার সঙ্গে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। পাশাপাশি ট্যাক্সোনমি ইন্টারঅপারেবিলিটি সেশনে দেখানো হয়- বিশ্বব্যাপী টেকসই অর্থায়নের মান ও কাঠামোকে একীভূত করা গেলে উদীয়মান অর্থনীতিতে বিনিয়োগ প্রবাহ বহুগুণ বাড়তে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রাজিল ও গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড একযোগে নতুন কান্ট্রি প্ল্যাটফর্ম এবং সাউথ-সাউথ নলেজ হাব চালুর ঘোষণা দেয়। এসব উদ্যোগ আঞ্চলিক সহযোগিতা, বিনিয়োগ পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান বিনিময়কে আরো শক্তিশালী করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠিত হয় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিপর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠক। সেখানে উঠে আসে প্রিমিয়াম এয়ার ট্রাভেলের ওপর ‘সলিডারিটি লেভি’ আরোপের প্রস্তাব। জলবায়ু অভিযোজন, ক্ষতি-ক্ষয়ক্ষতির তহবিল ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে এটি হতে পারে নতুন এক বড় অর্থের উৎস। বৈঠকে উন্মোচন করা হয় ‘দ্য আনট্যাপড পটেনশিয়াল অব সলিডারিটি লেভিজ’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের মূল সুপারিশও।
দিনের অন্যতম আলোচিত আয়োজন ছিল বাকু টু বেলেম রোডম্যাপ টু ১.৩ ট্রিলিয়নের ওপর উচ্চপর্যায়ের ইভেন্ট। এখানে কপ৩০ সার্কেল অব ফাইন্যান্স মিনিস্টার্স রিপোর্টের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের পথনকশা নিয়ে মতবিনিময় হয়। বৈশ্বিক জলবায়ু লক্ষ্য অর্জনে প্রতিবছর ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থায়ন কীভাবে সংগ্রহ করা যায়, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
এ ছাড়া ওপেন কোয়ালিশন অন কমপ্লায়েন্স কার্বন মার্কেটস বৈঠকে বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান কার্বন বাজারের মান, মূল্য নির্ধারণ এবং সহযোগিতা জোরদার করার লক্ষ্যে অভিন্ন কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
দিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সেশন ছিল সুপার পলিউট্যান্টস : দ্য ওয়ার্ল্ডস ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি ব্রেক শীর্ষক অনুষ্ঠান। এতে দ্রুত পদক্ষেপ নিলে কীভাবে স্বল্প ব্যয়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায়, তা তুলে ধরে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা।
দিনের শেষে কপ, সিএমপি ও সিএমএর যৌথ প্ল্যানারি বৈঠকে এসবি৬৩-এর রিপোর্ট উপস্থাপন করা হচ্ছে।
সার্বিক আলোচনা স্পষ্ট করেছে- আর্থিক ব্যবস্থার সংস্কার, ন্যায়সংগত সহযোগিতা এবং যৌথ রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছাড়া জলবায়ু রূপান্তরের পথ স্থায়ী ও টেকসই হবে না।
জলবায়ু সম্মেলনের প্রবেশপথ অবরোধ করল আদিবাসী বিক্ষোভকারীরা।
কেকে/এআর