কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার একমাত্র এমপিওভুক্ত মাদরাসা ব্রাহ্মণচর নোয়াগাঁও আলিম মাদরাসা এখন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে জর্জরিত। অভিযোগ উঠেছে, অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সুপার মো. শওকত হোসেন প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক ও আর্থিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও চেক জালিয়াতিসহ বিভিন্ন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। এতে মাদ্রাসার শ্রেণি কার্যক্রম প্রায় ভেঙে পড়েছে, শিক্ষার মান নেমে গেছে তলানিতে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র অসন্তোষ।
মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মো. রকিবুল ইসলাম গত ২৮ আগস্ট বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।
অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, শওকত হোসেন ম্যানেজিং কমিটির কয়েকজন সদস্যকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে চেক জালিয়াতি, ভুয়া বিল-ভাউচারের নামে অর্থ আত্মসাৎ ও মাদরাসার আয়-ব্যয়ের অর্থ ব্যাংকে জমা না রেখে ব্যক্তিগত খাতে ব্যয় করছেন।
অভিযোগেজানা যায়, ২০১৯ সালের পর থেকে মাদরাসাটি এমপিও নবায়নবিহীন অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে। ওই সময় স্থানীয় প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আনিছুর রহমান লিটু ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে নবায়ন ছাড়া তিনটি পদে নিয়োগ দেন। পরে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর সেই নিয়োগগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করে। পরবর্তী সুপার পদে নিয়োগ পাওয়া শাহজাহান অন্যত্র যোগদান করলে সহ-সুপার শওকত হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সুপারের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যা শিক্ষা নীতিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘন।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদরাসা) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ (২৩ নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সংশোধিত) অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি হালনাগাদ না থাকলে এমপিও অনুমোদন বা নিয়োগ বৈধ নয়। কিন্তু, এ বিধান উপেক্ষা করে ২০২৪ সালে তৎকালীন গভর্নিং বডি অবৈধভাবে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে। যা এটি প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৪২০ ও ৪৬৮ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
অভিযোগে আরও বলা হয়, ‘স্বীকৃতি নবায়নের উদ্দেশ্যে হিসাব নম্বর ১৫৬৯ থেকে উত্তোলিত ৩০ হাজার টাকা শওকত হোসেন ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। পাশাপাশি প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভাউচার প্রদানের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করারও অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে চেক সংক্রান্ত একটি মামলাও বিচারাধীন রয়েছে।’
অফিস সহকারী মিজানুর রহমান বলেন, “আমি তখন অফিসে দাপ্তরিক কাজ করছিলাম। হঠাৎ দেখি, কয়েকজন লোক অফিসে আসছেন। পরে ভারপ্রাপ্ত সুপার শওকত সাহেব বলেন, ‘‘তাদের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে, আপনি বাইরে যান।’’ এরপর আমি অফিসের কাজ রেখে বাইরে চলে যাই।’
অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২০ জুলাই মাদরাসার অ্যাডহক কমিটি জরুরি সভা করে। সভায় বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড ম্যানেজিং কমিটি অ্যান্ড গভর্নিং বডি প্রবিধানমালা-২০২৪ অনুযায়ী শওকত হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে দায়িত্ব থেকে অপসারণের পরও তিনি বেপরোয়া আচরণ ও কর্তৃত্বপরায়ণতা অব্যাহত রাখেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও নিয়োগের সময় থেকেই শওকত হোসেনের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ ছিল। চাকরিরত অবস্থায় তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া একটি নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নেন এবং সেই সনদ ব্যবহার করে উচ্চতর পদে নিয়োগ পান, যা বাংলাদেশ সার্ভিস রুলস ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালার পরিপন্থী। এতে তিনি প্রতারণা ও ক্ষমতার অপব্যবহারে লিপ্ত হয়েছেন বলে অভিযোগকারীরা দাবি করেন।
স্থানীয় শিক্ষা বিশ্লেষকরা মনে করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি শুধু শিক্ষার মানকেই ধ্বংস করছে না, বরং সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের ভয়াবহ দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।
তাদের মতে, নীতিমালার ১৮ (১) (ক) ধারা অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি হালনাগাদ না থাকলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের এমপিও অবিলম্বে স্থগিত বা বাতিলযোগ্য।
তাই, ব্রাহ্মণচর নোয়াগাঁও আলিম মাদ্রাসার সহকারী সুপার মো. শওকত হোসেনের এমপিও বাতিল করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
এ বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মো. শওকত হোসেন বলেন, ‘আমি মোবাইলে কিছু বলতে চাই না। আপনি একদিন মাদ্রাসায় আসেন, তাহলে বিস্তারিত জানতে পারবেন।’
কেকে/ এমএ