মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত লাশ হয়ে ফিরেলেন ৭২৪ প্রবাসী বাংলাদেশী। এদের মধ্যে হৃদরোগে ৫৬৪ জন, সড়ক দূর্ঘটনায় ৪৮ জন, কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় ১৯ জন, আত্মহত্যা করেছেন ৩২ জন ও অন্যান্য কারণে ৬১ জন মারা গেছেন। বেশিরভাগ প্রবাসীই মারা গেছেন হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। তাদের মধ্যে অনেকের বয়সই ৩০-৫০ বছর।
ঢাকাস্থ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য মতে, আবুধাবী দূতাবাস থেকে গত অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ২৯০ জন প্রবাসীর মৃতদেহের জন্য সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে। তার মধ্যে হৃদরোগে ২০০ জন, সড়ক দুর্ঘটনায় ১২ জন, কর্মস্থলে দূর্ঘটনায় ৬ জন, আত্মহত্যা করেছেন ৩২ জন ও অন্যান্য বা স্বাভাবিকভাবে ৫ জন প্রবাসী মারা গেছেন।
বাংলাদেশ কন্স্যুল্যেট দুবাই থেকে গত অর্থবছরে বাংলাদেশী ৪৮০ জন প্রবাসীর মৃতদেহের জন্য সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়েছে। তার মধ্যে হৃদরোগে ৩৬৪ জন, সড়ক দূর্ঘটনায় ২৭ জন, কর্মস্থলে দূর্ঘটনায় ১৩ জন, আত্মহত্যা করেছেন ২০ জন ও অন্যান্য বা স্বাভাবিকভাবে ৫৬ জন প্রবাসী মৃত্যুবরণ করেছেন।
আমিরাত বাংলাদেশী প্রবাসীদের মধ্যে স্ট্রোকে মৃত্যু যেন অনেকটাই নিয়তিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বদেশ-স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা এবং নানা মানসিক চাপের কারণে প্রবাসীদের স্ট্রোকে মৃত্যুর হার বেশি। বাংলাদেশীদের মধ্যে স্টোক বা হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জীবনযাত্রার ধরন, কর্মপরিবেশ ও সীমিত স্বাস্থ্যসচেতনতা।
উন্নত জীবনের আশায় কেউ জমি বিক্রি করে, কেউ ঋণ করে আমিরাতে এসেছেন। চাকরি না পাওয়া, ভিসা জটিলতাসহ নানা পরিস্থিতিতে কর্মহীন প্রবাসীরা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে মানসিক চাপে ভোগেন। এছাড়া বহু প্রবাসীর ঋণ পরিশোধের চাপ থাকায় অতিরিক্ত কাজ করার প্রবণতা আছে। ১২-১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করার কারণে নিয়মিত ঘুমানোর সুযোগ পান না- এসব প্রবাসী।
অন্যদিকে অবৈধভাবে থাকা অনেকের কাজের সুযোগ হয় না। তাদের প্রবাসের জীবনযাপনের ব্যয় দেশ থেকেই আনতে হয়। এসব কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। অবৈধভাবে থাকার ফলে প্রবাসীদের চাপ ও দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে যায়।
আমিরাতে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা সাধারণত কঠোর শ্রমঘন কর্মপরিবেশে ও তীব্র গরমে দীর্ঘ সময় কাজ করে থাকেন। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়াও পরিবার থেকে দূরে থাকার ফলে তাদের মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি হয়। পাশাপাশি, প্রতিদিনের খাবারে তেল-চর্বির পরিমাণ বেশি থাকা, পর্যাপ্ত ফলমূল ও শাকসবজি না খাওয়া, স্বাস্থ্য-সচেতনতার অভাব ইত্যাদি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। কারও কারও রয়েছে ধূমপানের অভ্যাস; যা হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। তাছাড়া, অনেকেই পারিবারিকভাবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরলে ভোগেন; যা বহু সময় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা না করায় অজানাই থেকে যায়। পরবর্তী তা জটিল আকার ধারণ করে ও ব্যক্তি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
এসব কারণে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা ও হৃদরোগের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থেকে ব্যক্তিজীবনে সেগুলোর চর্চা করলে প্রবাসজীবনে হৃদরোগের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
প্রবাসী বাংলাদেশি ও অভিবাসন খাত-সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘উচ্চ অভিবাসন ব্যয় প্রবাসীদের মানসিক চাপ বাড়ানোর অন্যতম কারণ। ঋণ নিয়ে বিদেশে গিয়ে টাকা শোধ করার চাপের কারণে অতিরিক্ত কাজ করার প্রবণতা রয়েছে শ্রমিকদের মধ্যে। ১২-১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করার কারণে নিয়মিত ঘুমানোর সুযোগ পান না শ্রমিকেরা। এসব কারণে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে। অথচ বাংলাদেশে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসে। দ্বিতীয় বৈদেশিক আয়ের এ খাতে সরকারের তেমন কোনো বিনিয়োগ নেই। প্রবাসীদের সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে দূতাবাসগুলোর জনবল ঘাটতির কথা বলা হয় প্রায়ই।
কেকে/ এমএ