ঢাকার সাভার উপজেলায় গুমের শিকার হয়েছিলেন দুই যুবদল নেতা ও এক বিএনপি নেতা এবং যুবদল নেতার গাড়ী চালকসহ ৪জন। তাদেরকে ৬ দিন অজ্ঞাত স্থানে রেখে ফেরত দেওয়ার কথা বলে পরিবার থেকে নেওয়া হয় মোটা অংকের নগদ টাকা। পরবর্তী তাদেরকে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে হাজির করে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল।
গুম হওয়া নেতারা জানান, তাদেরকে প্রথম ৩ দিন আয়না ঘরে বন্দি রাখা হয়েছিল। যেখানে তাদের হাত ও চোখ বাধা ছিল।
গুম হওয়া ব্যক্তিরা হলেন সাভার থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, সাভার পৌর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও যুবদল নেতা সুরুজ্জামান ও কাউন্দিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলাম এবং শহীদুল ইসলামের প্রাইভেটকার চালক সুজন আহমেদ।
ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০২৩ সালের আগস্ট মাস ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। দলের নেতাকর্মী অনেকেই গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি। এমন সময় সাভার থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলামসহ সাভারের বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের অনেকেই গ্রেফতার এড়াতে ঢাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন এবং নিয়মিত আন্দোলন সংগ্রামের কর্মসূচিতে অংশ নিতেন। ঢাকা জেলা উত্তর ডিবি পুলিশ সাভার থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলামকে ধরার জন্য ২০২৩ সালের ৫ আগস্ট প্রথমে তার প্রাইভেটকার চালক সুজন আহমদকে আটক করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। কিন্তু তার আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেন ডিবি পুলিশসহ ঢাকা জেলা পুলিশ। তাকে অজ্ঞাত স্থানে ১২ দিন আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন করা হয়।
এক পর্যায়ে শহীদুল ইসলামের ঢাকার আদাবরের বায়তুল আমান সোসাইটির ভাড়া বাসার সন্ধান পায় ডিবি। এ বাসায় অভিযান চালিয়ে আটক করা হয় সাভার থানা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম, সাভার পৌর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও যুবদল ঢাকা জেলা যুবদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সুরুজ্জামান ও কাউন্দিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল ইসলামকে। তাদেরকে আটকের পর অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
শহীদুল ইসলাম জানান, তাদেরকে আটক করে কালো কাপড় দিয়ে ৬দিন হাত ও চোখ বেধে রাখা হয়েছিল। ক্ষুধা লাগলে পাউরুটি, কলার মতো নামমাত্র খাবার দিত। প্রথম ৩ দিন যে ঘরে রাখা হয়েছিল, সেখানে বড় বড় ফ্যান চলার আওয়াজ শোনা যেত। প্রাকৃতিক ডাকে টয়লেটে গেলে হাতের বাধন খুলে আলগা করে দিত এবং রশি তাদের হাতে রেখে দিত। ছোট অন্ধকার কক্ষে ছিল না কোন খাট বা চৌকি।
মোমিনুল ইসলাম জানান, ধারণা করা হচ্ছে ওই কক্ষগুলো ছিল আয়না ঘর। সেখানে দুর থেকে মানুষের আত্মনাদ শোনা যেত। হাত ও চোখ বাধা অবস্থায় তাদেরকে শেষ ৩ দিন রাখা হয়েছিল সাভারে ঢাকা জেলা উত্তর ডিবি কার্যালয়ে। মানুষের কথোপোকথন ও গাড়ীর শব্ধ শুনে তারা এ ধারণা করছেন। এ সময় নাশকতার সাথে জড়িত থাকার কথা আদালতে শিকার উক্তি দিতে তাদেরকে দফায় দফায় পিটিয়ে গুরতর আহত করা হয়।
যুবদল নেতা সুরুজ্জামান জানান, তাকে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছে। নির্যাতনের ফলে তিনি একাধিক বার অচেতন হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি নাশকতার সাথে জড়িত মর্মে আদালতে স্বীকার উক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন। এই ৩ নেতা পুলিশের হাতে আটক থাকা সত্বেও পুলিশ তা অস্বীকার করে।
কিন্ত তাদেরকে উদ্ধার করে ফেরত দেওয়ার কথা বলে পরিবার থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে কয়েক কিস্তিতে নেওয়া হয় মোটা অংকের নগদ টাকা- এ কথা জানান শহীদুলের স্ত্রী সুরাইয়া হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীসহ অন্য আটককৃতদের অবস্থান সম্পর্কে জানতে পুলিশের নিকট বার বার ধরনা দিলেও তারা জানিয়েছেন- এমন কোন ব্যক্তিকে আটক করা হয়নি। পুলিশ আমাদেরকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে।
শহীদুল ইসলাম আরও জানান, শেষ দিন তাদের সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয় ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে। সেখানে নেওয়ার পথে সাভার থেকে ঘুরিয়ে কেরানীগঞ্জ এলাকায় নেয়া হয়। পথে একটি ছোট তেল পাম্পে তাদের বাসা হতে ডিবি পুলিশ কৃর্তক নিয়ে যাওয়া পোশাক পরিবর্তন করে পরানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে সেই পোশাকে তাদের উপস্থাপন করা হয়। ঢাকা জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোবাশ্বেরা চৌধুরী, সাভার সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহীদুল ইসলাম, ঢাকা জেলা উত্তর ডিবির ওসি রিয়াজ উদ্দিন বিপ্লব, ডিবির পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার পরিদর্শক মিজানুর রহমান, এসআই এমদাদ হোসেন, এসআই আমিনুল ইসলামসহ অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে তারা সেখানে দেখতে পান।
পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান তখন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘এ আসামীরা খুবই ধূর্ত ও ভয়ঙ্কর অপরাধী। আসামী শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে ৩০-৪০ জনের একটি গ্রুপ সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় নাশকতা কর্মকাণড করে আত্মগোপনে চলে যেত। তাদেরকে রাজশাহী, খুলনা ও রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান হতে নাশকতার কর্মকাণ্ড জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়েছে।
গাড়ী চালক সুজনকে তিনি সাভার মডেল থানা বিএনপির সদস্য হিসেবে উল্লেখ করেন।
শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপারের বক্তব্য ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। পুলিশ সুপার সেদিন আরও বলেছিলেন, আসামীরা ঢাকা আরিচা মহাসড়কের জাতীয় স্মৃতিসৌধের নিকট সম্প্রতি বাসে আগুন দিয়ে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করে সরকার বিরোধী কাজে জড়িত। তারা পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে দিতে পর পর বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করেছে।
এই ঘটনায় ভুক্তভোগীরা প্রশাসনের কাছে ঘটনার তদন্তপূর্বক দোষীদের শাস্তির দাবি জানান।
কেকে/ এমএ