পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে ৫ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) একটি সড়ক নির্মাণে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, নিময়-নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্মাণকাজের শুরু থেকেই ঠিকাদারের লোকজন নকশা (ডিজাইন) বহির্ভূতভাবে কাজ করার পাশাপাশি মানহীন সামগ্রী ব্যবহার করছেন। সবার চোখের সামনে ঠিকাদার কাজ ফাঁকি দিয়ে প্রকল্পের টাকা লোপাট করছেন বলেও দাবি স্থানীদের। কিন্তু সব দেখেও যেন না দেখার ভান করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এলজিইডির উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরিশাল বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা ও ইউনিয়ন সড়ক প্রশস্তকরণ এবং শক্তিশালীকরণ (বিডিআইআরডব্লিউএসপি) প্রকল্পের আওতায় রাঙ্গাবালী উপজেলার কাছিয়াবুনিয়া (খালগোড়া) লঞ্চঘাট বাজার থেকে বাহেরচর বাজার (উত্তর কাজির হাওলা মোহসেনিয়া মাদ্রাসা) পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার আরসিসি সড়ক নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়। ৫ কোটি ২৪ লক্ষ ৯৩ হাজার ২০৯ টাকায় কাজটি পায় রাজশাহীর সাহেব বাজার এলাকার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বরেন্দ্র কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মূল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে সাব-ঠিকাদার হিসেবে কাজটি করছেন দশমিনা উপজেলা সদরের বাসিন্দা জুয়েল মোল্লা। এলজিইডির তথ্য অনুযায়ী, গতবছর শুরু হওয়া এই কাজের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ। ৬০০ মিটার সড়ক আরসিসিকরণ কাজ শেষ হয়েছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে নির্মাণের শুরু থেকে মানসম্মত কাজ হচ্ছে না। এখন পর্যন্ত যতটুকু কাজ হয়েছে তার পুরোটাতেই অনিয়ম হয়েছে। কাজ শেষ হতে না হতেই পাথর উঠে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন তারা। ফলে সড়কটির স্থায়ীত্ব নিয়ে জনমতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামলে এর প্রমাণও পায় খোলা কাগজের এ প্রতিবেদক। সড়ক নির্মাণকাজ চলাকালীন সেখানে গিয়ে দেখা যায় ঢালাই চলছে। কিন্তু এই ঢালাইয়ে ব্যবহৃত পাথর ও বালুতে মিশে আছে কাঁদামাটি। এই কাঁদামাটি মিশে থাকা বালু-পাথর দিয়েই ঢালাই দেওয়া হয়। ঢালাইয়ে ব্যবহার করা হয় জমাট বেঁধে চাক চাক হয়ে যাওয়া সিমেন্টও। তা দিয়েই চলছিল ঢালাইয়ের কাজ।
আর অকোপটে মানহীন সামগ্রী দিয়ে কাজ চলার কথা স্বীকারও করেন নির্মাণ শ্রমিকরা। ঢালাই কাজে নিয়োজিত শ্রমিক সরদার ওয়াহাব হোসেন বলেন, ‘আমাদেরকে কন্ট্রাক্টর (ঠিকাদার) নির্দেশ করছে, আমরা এভাই পুরো কাজ করেছি। কন্ট্রাক্টর যেমন দিয়েছে, আমরা দিনমজুর মানুষ তেমনি করছি। আমরা দেহি (দেখছি) অর্ধেক পাথরের সঙ্গে অর্ধেক কাঁদা। পাথরের সঙ্গে মাটি আমরা দেখতেছি। বালুর সঙ্গেও মাটি। এসব পরিষ্কার করা বা পানি দিয়ে পাথর ধোঁয়াতো আমাদের কাজ না। আমরা কি করবো? সিমেন্টের মধ্যেও চাক চাক। অনেক চাক ফেলে দিয়েছি।’
শুধু মানহীন সামগ্রী ব্যবহার করেই ক্ষ্যান্ত হননি ঠিকাদার! রড সাশ্রয়ী করতে নকশা বর্হিভূত কাজ করার প্রমাণও মিলেছে অনুসন্ধানে। নকশা অনুযায়ী, দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে ৭ ইঞ্চি পর পর ঢালাইয়ের জন্য ১০ মিলি রড দিয়ে জালি করার কথা। কিন্তু রড সাশ্রয়ী করতে ঘনত্ব কমিয়ে দুই ইঞ্চি ফাঁকা বেশি দিয়ে ৯ ইঞ্চি পর পর রড বেঁধে জালি করা হয়েছে। সেই জালির ওপর ঢালাই দেওয়া হচ্ছিল।
বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সরাসরি স্বীকারোক্তি দেন কাজের মূল রাজমিস্ত্রী আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, ‘ঠিকাদারের নির্দেশনা অনুযায়ী রডের জালি বেঁধেছি। ৯ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ৯ ইঞ্চি প্রস্থ দিয়েছি।’ নকশা অনুযায়ী দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থে ৭ ইঞ্চি পরপর রড বেঁধে জালি করার নিয়ম প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের উত্তরে এই রাজমিস্ত্রী বলেন, ‘রড কম। তাই ঠিকাদার এভাবে করতে বলছে। এরআগে যতটুকু করেছি তাতে ৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য এবং ৮ ইঞ্চি প্রস্থ দিয়েছি।’ পাথরের সঙ্গে কাঁদামাটি, সিমেন্ট জমাট বেঁধে যাওয়া এবং কাঁদামাটি মিস্ত্রিত নিম্নমানের বালু দিয়ে ঢালাই কাজ চলছে এমন প্রশ্ন করা হলে রাজমিস্ত্রী বলেন, ‘ঢালাই মিক্সের ওখানে আমি যাই না। আমি ওখানে থাকি না। আমি এখানে ঢালাই করি। ম্যানেজার ও ইঞ্জিনিয়ার আছে, তারা জানে।’
ঠিকাদারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজটির দেখভালের জন্য দায়িত্ব থাকা উপজেলার বড়বাইশদিয়া ইউনিয়নের মধুখালী গ্রামের বাসিন্দা রুহুল আমিনকে হাতেনাতে এমন প্রমাণ ধরিয়ে দিলেও কৌশলে তিনি সব এড়িয়ে যান। পরে প্রথমেই জমাট বেঁধে চাক চাক হয়ে যাওয়া সিমেন্ট দিয়ে ঢালাই চলছে এমন প্রমাণ দেখালে রুহুল আমিন বলেন, ‘প্রতিটি সিমেন্টে চাক ধরেনি। বৃষ্টির পানি পেয়ে দুই-একটি সিমেন্টে এরকম টুকরা হয়েছে। টুকরাগুলো আমরা ফেলে দিচ্ছি। এখন দিবো না।’ পরে কাদামাটি মেশানো পাথর দিয়ে ঢালাই কাজ চলছে চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখালে ঠিকাদারের এই প্রতিনিধি বলেন, ‘পাথরে ময়লা নাই। আপনি যদি বলেন তাহলে ধুঁয়ে দিবো।’ সবশেষে প্রাক্কলন (এস্টিমেট) না মেনে দুই ইঞ্চি করে রডের ঘনত্ব কমিয়ে জালি বেঁধে ঢালাই হচ্ছে এমনটা দেখালে তিনি বলেন, ‘আমি ৮ ইঞ্চি বাই ৮ ইঞ্চি রড বাঁধতে বলেছি।’ নিয়ম অনুযায়ী আপনিও এক ইঞ্চি ঘনত্ব কমাতে বললেন কেন প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাকে ইঞ্জিনিয়ার এভাবে বলেছেন।’
সড়ক নির্মাণকাজের সাব-ঠিকাদার দশমিনা উপজেলা সদরের বাসিন্দা জুয়েল মোল্লা মোবাইলে বলেন, ‘আমি বলছি ডিজাইন অনুযায়ী কাজ করতে। ডিজাইনের বাহিরে কাজ করতে নিষেধ করেছিলাম। পাথর যেখানে রাখছি, সেখানে জোয়ারের পানি ওঠে। অন্য কোন জায়গা পাই নাই। আপনার কথা সব সঠিক আছে। পরবর্তী সময় এরকম আর হবে না। আমি আপনাকে ওয়াদা দিলাম।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা প্রকৌশলী মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ঠিকাদার আমাদের জানিয়ে কাজ শুরু করার কথা। কিন্তু সোমবার আমাকে অবগত না করে কাজটি শুরু করেছিল। বিষয়টি শুনে আমার প্রতিনিধি গিয়ে কাজটি বন্ধ করে। যেহেতু আমাদের না জানিয়ে ডিজাইনের বাহিরে কাজটি করছিল, সেক্ষেত্রে ঠিকাদারকে আমরা বলে দিয়েছি ডিজাইন অনুযায়ী ঢালাই প্রস্তুত করতে। আমরা পরীক্ষা করবো, তারপর কাজ করবো।’
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজীব দাশ পুরকায়স্থ বলেন, ‘সড়ক নির্মাণে অনিয়মের বিষয়টি জেনে আমি ইতোমধ্যে উপজেলা প্রকৌশলীকে বলেছি। উনি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে সতর্ক করে দিয়েছেন। এ ধরণের উন্নয়ন কাজে কোন ধরণের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া হবে না। ঠিকাদার কিংবা যে কেউ এর সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’