# ২০০ বছরের পুরনো কবর ধ্বংসের পথে
# নদীর ভাঙন ও অবাধ বালু উত্তোলনের কারণে স্থানীয় ইতিহাস হারানোর শঙ্কা
অবাধে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলনের ফলে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ধুরুং নদীতে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে উপজেলার কাঞ্চননগর ইউনিয়নের আব্দুল হাফেজ কেরানির বাড়ীর পারিবারিক কবরস্থান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো এই কবরস্থানে শায়িত আছেন স্থানীয় খ্যাতিমান আলেম মাওলানা রহমত উল্লাহের (শাহ.) বংশধর মাওলানা অছিউদ্দিন মিয়াজিসহ পরিবারের বহু প্রজন্ম। একইভাবে ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পল্লান পাড়ায় নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে গ্রামের ২০০ বছর পুরনো আরও একটি কবরস্থান।
জানা যায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ধুরুং খালের ৪টি স্থানে অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। যার ফলে নীর খরস্রোতা বৃদ্ধি পেয়ে নদীটি রাক্ষুসী দানবে পরিণত হয়েছে। ফলে নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে পূর্বপুরুষের কবরস্থান ও ফসলি জমি।
স্থানীয়দের দাবি, ড্রেজারে বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে ২০০ বছর পুরনো কবরস্থান দুইটির বাকি অংশও মুছে যাবে অতল গহ্বরে।
তাদের ভাষ্যমতে, এ কবরস্থান শুধু কয়েকটি পরিবারের নয়। পুরো এলাকার আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে মানুষ এখানে পূর্বপুরুষদের সমাধিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে আসছিল। কিন্তু নদীর ভয়াবহ ভাঙনে একে একে কবরগুলো ধসে নদীতে হারিয়ে যাচ্ছে।
এ ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে শোক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আবুল হাসান রুবেল বলেন, ‘ড্রেজার দিয়ে অবাধে বালু তোলা হচ্ছে। এতে নদীর স্রোতের ধারা পাল্টে গেছে। ফলে এখন ভয়াবহ ভাঙন হচ্ছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের কবর নদীতে চলে যাচ্ছে। এটা শুধু প্রাকৃতিক ভাঙন নয়, মানুষের লোভের কারণেই এই বিপর্যয় হচ্ছে।’
মাওলানা রহমত উল্লাহের (শাহ.) বংশধর তাইমুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের দাদা-পরদাদারা এখানে শায়িত আছেন। কবরগুলো হারিয়ে যেতে দেখা আমাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের। খালে ড্রেজিং বন্ধ না হলে পুরো কবরস্থানই একদিন নদীতে মিশে যাবে।’
এলাকার প্রবাদ পুরুষ মাওলানা অছিউদ্দিন মিয়াজির নাতি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই কবরগুলো শুধু মাটির টিলা নয়। এগুলো আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক। অথচ মানুষের অবহেলায় এগুলো নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। এটি আমাদের জন্য মহা যন্ত্রনার।’
কাঞ্চননগর ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলনের বিষয়টি আমরা জেনেছি। খুব শিগগিরই এ বিষয়ে অভিযান চালানো হবে। খালের ভাঙনের কারণে কবরস্থান হুমকির মুখে পড়েছে। এটি শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো এলাকার জন্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। আমরা চাই, সরকার দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।’
ধুরুং নদীর ভাঙনে কেবল কবরস্থানই নয়, আশপাশের ফসলি জমি, বসতবাড়িও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। স্থানীয়রা অনেকবার বাঁশ, কাঠ ও বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন। তবে নদীর প্রবল স্রোতের কারণে এসব অস্থায়ী উদ্যোগ কোনো কাজে আসেনি।
চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী সোহাগ তালুকদার বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ পাল্টে যাচ্ছে। এর কারণে ভাঙন আরও তীব্র আকার ধারণ করছে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য টেকসই বাঁধ নির্মাণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। অবাধে ড্রেজার মেশিনে বালু উত্তোলন চলতে থাকলে কেবল পারিবারিক কবরস্থানই নয়, পুরো এলাকার কৃষিজমি, বসতবাড়ি ও ঐতিহ্যও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।’
হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মন্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন নদীর প্রতিবেশ ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য ভয়াবহ হুমকি। ফলে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে এবং নদীভাঙনও দিন দিন বাড়ছে।’
ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মুজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ড্রেজারের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও নদীভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কবরস্থানসহ মানুষের বসতভিটা ও খালের বেড়িবাঁধ রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।’
কেকে/ এমএ