সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দুটোই দেখা যায়। আছে রাখাইন পল্লী, জেলেদের জীবন-জীবিকা দেখার পাশাপাশি ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ট্রলার কিংবা স্পিড বোটে চড়ে দেখার সুযোগ। দক্ষিণাঞ্চলের অপার সৌন্দর্যে ঘেরা নৈসর্গিক কুয়াকাটা সৈকত ‘সাগরকন্যা’ নামে খ্যাত। শোভাবর্ধনে টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা ও সৈকতে পর্যটকদের নিরাপত্তার অভাব, অব্যবস্থাপনা ও অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যের কারণে পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে সারগকন্যা থেকে। ২০১০ সালে কুয়াকাটা পৌরসভা গঠিত হলেও গত ১৫ বছর ধরে টেকসই উন্নয়নের ছোঁয়া বঞ্চিত।
পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার সঙ্গে কুয়াকাটার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। যেখানে পদ্মা সেতু নির্মাণের পূর্বে কুয়াকাটা যেতে কয়েকটি ফেরি পার হতে হতো, সেখানে বর্তমানে ঢাকা থেকে কুয়াকাটা যেতে কোন ফেরি পারাপার ছাড়াই সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় সময় লাগছে ৬-৭ ঘন্টা। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় কুয়াকাটায় বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান চালু করতে জমি কিনেছেন। তবে কুয়াকাটা পর্যটন ব্যবসায় ঘিরে টেকসই মাস্টার প্ল্যানের অভাবে বিনিয়োগকারীদের ব্যবসায় শুরুর চিন্তা ভাবনায় বিরুপ প্রভাব ফেলেছে।
টেকসই পরিকল্পনার অভাবে পর্যটক হারাচ্ছে কুয়াকাটা- ছবি: তানজেরুল ইসলাম
সরেজমিনে দেখা গেছে, কুয়াকাটা ভ্রমণে আসা পর্যটকদের সেবা দিতে না পারার অন্যতম কারণ অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা। পর্যটক সমাগমের মৌসুমে হোটেল মোটেল ভাড়া আকাশচুম্বি। কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্টে নেই মানসম্মত কোন খাবার হোটেল। পর্যটক সমাগমের মৌসুম ছাড়াও ঊর্ধ্বমুখী হোটেল মোটেল ভাড়া আদায় ঠেকাতে নেই প্রশাসনের নজরদারি। কুয়াকাটায় পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান। তবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভাঙ্গনের ফলে জাতীয় উদ্যান বিলীন হওয়ার পথে। সাগরপাড়ে রয়েছে ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল ও ব্যাটারি চালিত ভ্যান চালকদের দৌরাত্ম্য। সৈকতে যত্রতত্র ফেলা হয়েছে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব। যদিও প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও ভাঙ্গন ঠেকানো যাচ্ছে না। সৈকত পাড়ে পর্যটকদের জন্য নেই পর্যাপ্ত শৌচাগার, বিশ্রামাগারসহ পোশাক পরিবর্তনের ব্যবস্থা। এ ছাড়া স্থানীয় ভ্রাম্যমাণ হকারদের নেই সচেতনতা ও পরিবেশ রক্ষার জন্য চেষ্টা। সৈকতের পাড়জুড়ে হকারদের উপদ্রবে সাগরকন্যার সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসা দর্শনার্থীরা তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যাচ্ছে।
সরেজমিনে আরও জানা গেছে, কুয়াকাটা পৌরসভায় পর্যটকদের চাহিদা পূরণে শতাধিক হোটেল নির্মিত হলেও নেই পরিকল্পনার ছোঁয়া। হোটেলগুলোতে সেবার মান নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই পর্যটকদের। আবার অধিকাংশ আবাসিক হোটেলের নেই অনুমোদন। সরকারিভাবে অনুমোদন পেতেও বিভিন্ন জটিলতায় হোটেল মালিকদের দুর্ভোগের শেষ নেই। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন করা হয়েছে কুয়াকাটায়। এতে শোভাবর্ধনের পরবর্তে শ্রীহীন হয়েছে কুয়াকাটা। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত কুয়াকাটা মেরিন ড্রাইভ সড়ক। প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সড়কটি উদ্বোধনের আগেই ভেঙ্গে পড়েছে।
টেকসই পরিকল্পনার অভাবে পর্যটক হারাচ্ছে কুয়াকাটা- ছবি: তানজেরুল ইসলাম
সবুজ আন্দোলনের চেয়ারম্যান বাপ্পি সরদার বলেন, ‘কুয়াকাটায় টেকসই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে। কুয়াকাটা শহরকে সাগরের ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করতে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান ভাঙ্গনে বিলুপ্তির পথে। সঙ্গত কারণে, দেশীয় যেসব প্রজাতির বৃক্ষ হারিয়ে গেছে, সেসব প্রজাতি পুনরায় রোপণ করতে হবে। কেননা, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কুয়াকাটায় মারাত্নকভাবে পড়েছে। শুধু কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সাগরকন্যাকে কিভাবে রক্ষা করা যায়, কিভাবে মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করা যায়, সেই উদ্যোগ নিতে হবে।’
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন বলেন, ‘কুয়াকাটায় অপরিকল্পিতভাবে মেরিন ড্রাইভ নির্মাণ করা হয়েছিল। পানির তোড়ে সড়কটির বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে গেছে। আপাতত পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুর বস্তা ও জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন রক্ষার চেষ্টা করছে।’
কুয়াকাটা নিয়ে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে বলেও তিনি জানান।