চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা যেন খুন, অপহরণ ও মব আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। মব সৃষ্টি করে, পিটিয়ে ও কুপিয়ে মানুষ হত্যা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সন্ধ্যা হলেই জনমনে ভর করে এক অজানা আতঙ্ক।
২০২৪ সালের ৫ আগষ্ট দেশে পট-পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক শৃঙ্খলা যেন বেসামাল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নাজুক। গত এক বছরে প্রায় প্রতিদিনই ঘটেছে মারামারি, চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, রাজনৈতিক সহিংসতা, লুটতরাজ, সরকারি সংরক্ষিত বনের গাছ পাচার, পাহাড় নিধন, খুনসহ বিভিন্ন এলাকায় জমি দখল-বেদখলের ঘটনা। চট্টগ্রামের বৃহত্তর এই উপজেলার দুুই থানার পুলিশ আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া। তবে জনসচেতনতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে শৃঙ্খলা ফিরছে না বলে অভিমত সচেতন মহলের।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এই বছরের আগষ্ট পর্যন্ত ফটিকছড়ি উপজেলায় খুন হয়েছেন ১৮ জন নর-নারী। এছাড়া প্রভাব বিস্তার, অপহরণ, মব সৃষ্টি যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭৭৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলায় রয়েছে ফটিকছড়ি ও ভুজপুর নামে দু’টি থানা। অপরাধের তুলনামুলক বিচারে ফটিকছড়িকে ছাড়িয়ে গেছে ভুজপুর থানা। এই থানায় অপরাধের মাত্রা বেশি। ফটিকছড়ি থানা এলাকায় খুন হয়েছেন ৮ জন এবং ভুজপুর থানা এলাকায় খুন হয়েছেন ১০ জন। এছাড়া ভুজপুর থানা এলাকায় দুইটি অপহরণ ও একাধিক বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নি-সংযোগের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
ফটিকছড়ি থানা এলাকায় সর্বশেষ গত ২২ আগস্ট মব সৃষ্টি করে গণপিটুনিতে ঘটনাস্থলেই খুন হয়েছেন মো. মাহিন (১৫) নামে এক স্কুলছাত্র। এ ঘটনায় আরো দুই কিশোর গুরুতর আহত হয়। বর্তমানে তারা চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঘটনাটি সারা দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়। এছাড়া ২০ জুলাই লেলাং খাল থেকে সন্তোষ নাথ (৪০) নামে এক ট্যাক্সি চালকের হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার, ১৮ জুলাই নাজিরহাট পৌরসভার পূর্ব ফরহাদাবাদ গ্রামে পুকুর থেকে মো. এনাম (৬০) নামে এক বৃদ্ধের লাশ উদ্ধার, ৫ জুলাই নাজিরহাট পৌরসভা এলাকায় মো. জাহাঙ্গীর আলম (৫৫) নামে এক ব্যক্তির তার বাড়ির সিঁড়িরুম থেকে লাশ উদ্ধার, ২২ জুলাই মাইজভান্ডারে নিজ ঘরের বাথরুম থেকে মো. আরমান (২৮) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার, ৮ আগস্ট ফটিকছড়ি পৌরসভার রাঙ্গামাটিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘর থেকে আবুল মনছুর প্রকাশ মনছুর বৈদ্য (৪৫) নামে এক ব্যক্তির গলাকাট লাশ উদ্ধার ও গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে দেশে ফিরে আলমগীর আলম (৪০) ও জাহাঙ্গীর আলম (৪৫) নামে দুই সহোদরকে মব সৃষ্টি করে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।
এসব ঘটনায় বিভিন্ন ধারায় মামলা হয়েছে ফটিকছড়ি থানায়। মামলা পরবর্তী অধিকাংশ আসামীদের ধরতে সক্ষম হয়েছে বলে দাবী করেন ফটিকছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মর্কতা (ওসি) নূর আহমদ। তিনি জানান, গত এক বছরে সৃষ্ট ঘটনায় প্রায় আসামিকে ইতিমধ্যে গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে । অন্যদের গ্রেফতারে পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে, ফটিকছড়ি থানা থেকে আইনশৃঙ্খলা অবনতির একধাপ এগিয়ে ভূজপুর থানা এলাকা। গত ১ বছরে বিভিন্ন অপরাধে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে নারী, পুরুষ ও শিশুসহ অন্তত ১০ জন । সর্বশেষ গত ১ মাসে দু’টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। গত ৫ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ভূজপুর কাজিরহাট বাজারের জেনারেল হাসপাতালের পাশের এক ভাড়া বাসা থেকে এনজিও পরিচালক মোহাম্মদ জসীম উদ্দীনকে (৩৮) তুলে নিয়ে যায় একদল অপহরণকারী। পরে ৭ লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে ছাড়া পান তিনি। একইভাবে ৯ আগস্ট গভীর রাতে হারুয়ালছড়ি এলাকার রাঙ্গাপানি চা বাগান থেকে পুলিশ পরিচয়ে ১৭ বছরের কিশোর সাজু ত্রিপুরাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে দুইদিন পর বিবিরহাট বাসস্ট্যান্ডে অপহরণকারীরা অপহৃত কিশোরকে ছেড়ে হাতমুখ বাঁধা অবস্থায় ছেড়ে দেন।
এছাড়া, ভুজপুর ইউনিয়নে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ৬ এপ্রিল জুলেখা খাতুন (৫৫) নামে এক মহিলা নিজের ছেলের হাতে খুন হয়েছেন । গত ৩ এপ্রিল একই এলাকায় মো. মাসুম (৩৩) নামে এক যুবক প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছেন। একই দিনে জঙ্গল হারুয়ালছড়ি গ্রামের সুরেণ রায়ের ছেলে তন্ময় রায় (১৩) তার বন্ধুদের দায়ের কোপে নিহত হয়েছেন। গত ১৮ মার্চ দাঁতমারা শান্তিরহাট বাজারে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রমজান আলী (২২) নামে এক যুবক প্রকাশ্যে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছেন। গত ৫ জুলাই উদালিয়া চা-বাগান এলাকায় সুপ্তা মাজি (১৫) নামে এক চা-শ্রমিককে কুপিয়ে হত্যা করে তারই আপন চাচাতো ভাই। গত ২৭ ফেব্রুয়ারী নিউ দাঁতমারা চা বাগানের ভেতর নিখোঁজের দুই দিন পর মো. বেলাল উদ্দিন (৪৫) নামে এক অটোচালকের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেছে ভুজপুর থানা পুলিশ। গত ১ ফেব্রুয়ারী দাঁতমারা ইউপির বড় বেতুয়া গ্রামে মো. শহীদ (৩২) নামে এক বিএনপিকর্মীকে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে প্রতিপক্ষের লোকজন পিটিয়ে হত্যা করে। গত ১২ জানুয়ারি হারুয়ালছড়ি ইউপিতে আনিকা আক্তার (১৮) নামে এক যুবতীকে তার মা ও ছোটভাই পারিবারিক কলহের জের ধরে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। গত ৯ জানুয়ারি বাগানবাজার ইউপিতে বালু উত্তোলনে বাঁধা দিতে গেলে দুলায়েত হোসেন (৬০) নামে এক কৃষককে অবৈধভাবে বালি উত্তোলনকারীরা পিটিয়ে হত্যা করে । গত বছরের ২৯ নভেম্বর নিখোঁজের ১৩ দিন পর একটি পরিত্যক্ত টয়লেট থেকে তাবাচ্ছুম (৬) নামে এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে ভুজপুর থানা পুলিশ।
ভুজপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহাবুবুল হক জানান, এলাকার আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে পুলিশ সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। যেসব হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশ আসামিকেই ইতিমধ্যে গ্রেফতার করে বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেফতারে পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাটহাজারী সার্কেল) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ কাজ করছে। যেসব হত্যাকান্ডেট ঘটনা ঘটেছে প্রায় ঘটনার আসামিদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এর বাইরে রাত্রিকালীন টহল জোরদার করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় এলাকায় সচেতনতামুলক বিভিন্ন অনুষ্ঠান করছি। পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।
কেকে/ আরআই