জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার রায়কালী ইউনিয়নের বালুকাপাড়া গ্রামের দিনমজুর জলিল প্রামাণিক। তাকে দেড় বছর ধরে সামাজিক কোনো কাজে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। ‘একঘরে (সমাজচ্যুত) করে রাখায় তাকে দেওয়া হতো না কুরবানির মাংস। নেওয়া হতোনা দিনমুরের কাজে। কারণ দেড় বছর আগে তার স্ত্রীকে রাগের মাথায় ‘তিন তালাক’ দিয়ে ২৯ দিন পর হিল্লা বিয়ে না করে পুনরায় বিয়ে করে আগের স্ত্রীকে নেন তিনি। এটাই তার অপরাধ। এতেও ক্ষান্ত হয়নি গ্রামের প্রভাবশালীরা। ওই ঘটনার জের ধরে প্রভাবশালীরা তাকে মসজিদে যাওয়ার পথে মারধর করেন। এতে তার বাম হাতের হাঁড় ভেঙে গেছে। এঘটনায় তিনি থানায় ৮ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন।
মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) রাতে মামলাটি রেকর্ড করা হয়। তবে মামলার এজাহারে সমাজচ্যুত বা একঘরে করে রাখার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি।
বালুকাপাড়া গ্রামে গিয়ে জলিল প্রামাণিককে প্রায় দেড় বছর ধরে ‘একঘরে (সমাজচ্যুত) করে রাখার তথ্য জানা গেছে। ‘একঘরে (সমাজচ্যুত) করার ঘটনাটি স্থানীয় রায়কালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রশীদ মন্ডলও অবগত আছেন। তিনি দুই পক্ষকে ইউপি কার্যালয়ে ডেকেও সমাজচ্যুত করে রাখার বিষয়টি সমাধান করতে পারেননি।
গ্রামবাসী ও ভূক্তভোগী পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক কলহের কারণে আব্দুল জলিল প্রামাণিক রাগের মাথায় তার স্ত্রীকে তালাক দেন। এ ঘটনার ২৯ দিন পর তিনি আবারো স্ত্রীকে বিয়ে করেন। এতে গ্রাম্য মাতব্বরেরা ক্ষুব্ধ হয়ে আব্দুল জলিল প্রামাণিকের পরিবারকে ‘একঘরে’(সমাজচ্যুত) করে রাখেন। সেই সময় জলিল প্রামাণিক বিষয়টি আক্কেলপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কে জানান। ইউএনও রায়কালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদ মণ্ডলকে বিষয়টি সমাধানের দায়িত্ব দেন। ইউপি চেয়ারম্যান উভয়পক্ষকে ডেকে নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে বৈঠকে বসেছিলেন। তবে কার্যত কোনো সমাধান করতে পারেননি তিনি।
এতে গ্রাম্য মাতব্বরেরা জলিল প্রামাণিকের ওপর আরো ক্ষুব্ধ হন। একঘরে করে রাখা আব্দুল জলিল গত ১৫ আগস্ট রাত আটটার দিকে গ্রামের দোকানের যাচ্ছিলেন। এসময় মাতব্বরেরা তাকে দুই দফায় মারধর করেন। এতে তার বাম হাতের হাঁড় ভেঙে যায়। তিনি চিকিৎসা নিয়ে থানায় আট জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
বালুকাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্রায় দেড় বছর আগে আব্দুল জলিল তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিলেন। কয়েক দিন পর আবারো সংসার শুরু করেন। এনিয়ে গ্রামের মাতব্বরেরা আব্দুল জলিল প্রামাণিককে ‘একঘরে’(সমাজচ্যুত) করেন। এনিয়ে কথাকাটাকাটির জেরে মারপিটের ঘটনা ঘটেছে।
ওই গ্রামের বৃদ্ধা লুৎফুন নেছা বলেন, আমি কাজ করতে পারিনি। আব্দুল জলিলের বউ আমার বাড়িতে এসে জবাই করা মুরগির তরকারি রান্না করে দিয়েছিল। আমি জলিলের বাড়িতে গিয়ে এক বাটি মুরগির মাংসের তরকারি দিয়ে এসেছি। এতে আমাকেও ‘একঘরে’(সমাজচ্যুত) করার হুমকি দিয়েছিল তারা।
আব্দুল জলিল বলেন, আমি রাগের মাথায় স্ত্রী তালাক দিয়েছিলাম। ২৯ দিন পর আবার বিয়ে পড়ে নিয়েছি। হিল্লা বিয়ে না করার কারণে গ্রামের মাতব্বর রকি খান, মিল্টন খাঁ, আবু সুফিয়ানসহ ১০-১২ জন আমাকে ‘একঘরে’ (সমাজচ্যুত) করেছেন। রাগের মাথায় স্ত্রীকে তালাক দিলে পুনরায় বিয়ে করা যাবে ঢাকার একজন মুফতির মতামত নিয়ে আসার পরও তারা মানেনি। তারা বলছে হিল্লা বিয়ে ছাড়া আমার বিয়ে নাকি বৈধ হবে না। তারা আমাকে দীর্ঘ দেড় বছর ধরে গ্রামের মসজিদে নামাজ আদায়ে করতে ও জানাজায় শরিক হতে বা দেননি। মিলাদ মাহফিলে দাওয়াত দিলেও মাতব্বরদের চাপে পর ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি গ্রামের কারও জমিতে দিনমজুরি কাজও করতে পারব না বলে লোকজন জানিয়ে দেন। একারণে কেউ আমাকে কাজে নেয় না। ‘একঘরে’(সমাজচ্যুত) করার জের ধরে মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়ার সময় মাতব্বরদের একাংশের লোকজন আমাকে মেরে হাত ভেঙে দিয়েছে।
গ্রামের মাতব্বরদের মো. মিল্টন বলেন, আব্দুল জলিল সমাজ বিরোধী কাজ করেছেন। একারণে গ্রামের লোকজন তাকে ‘একঘরে’ (সমাজচ্যুত) করেছেন। আব্দুল জলিল সমাজ বিরোধী কি কাজ করেছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আব্দুল জলিল তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে হিল্লা বিয়ে না করে আবার স্ত্রীকে নিয়েছেন। এটা সমাজ বিরোধী কাজ।
রায়কালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রশীদ মন্ডল বলেন, আব্দুল জলিল মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তিনি রাগের মাথায় স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিলেন। এঘটনায় গ্রামের মাতব্বরেরা আব্দুল জলিলকে সমাজচ্যুত করেন। আব্দুল জলিল ইউএনও স্যারের কাছে অভিযোগ দিয়েছিলেন। ইউএনও স্যার আমাকে ঘটনাটি সমাধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। উভয়পক্ষকে ইউপি কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে বৈঠক করেছি। আব্দুল জলিল যেন সামাজিকভাবে মিশতে পারে সেটি বলেছি। একঘরে করে রাখার ঘটনার জের ধরে আব্দুল জলিলকে মারধর করা হয়েছে। এতে তার বাম হাত ভেঙেছে বলে জেনেছি।
আক্কেলপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শফিকুল ইসলাম বলেন, আব্দুল জলিল প্রামাণিক থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছিলেন। অভিযোগটি তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় সেটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার মনজুরুল আলম বলেন, একঘরে রাখা সামাজিক অপরাধ। এই সংক্রান্ত একটি অভিযোগ আসার পর বিষয়টি সমাধান করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেকে/এআর