বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক ব্যবসায়ী সংগঠন বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিসিসিসিআই) অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে চরম সংকটে পড়েছে।
প্রেসিডেন্টের দেশত্যাগ, অ্যাক্টিং প্রেসিডেন্ট নিয়োগ নিয়ে বিভ্রান্তি, প্রশাসক নিয়োগে মন্ত্রণালয়ের একতরফা সিদ্ধান্ত এবং আদালতের অনীহা—সব মিলিয়ে সংগঠনটি এখন কার্যত ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অভ্যন্তরীণ এই অস্থিরতা শুধু চেম্বারের কার্যক্রমেই নয়, বরং বাংলাদেশ-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট, দায়িত্ব নিয়ে বিভ্রান্তি
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে সংগঠনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতিতে চেম্বারের কার্যক্রম সচল রাখতে বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের সাধারণ সম্পাদক জরুরি বৈঠক ডাকেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, প্রবীণ সদস্য খোরশেদ আলমকে অ্যাক্টিং প্রেসিডেন্ট করা হবে এবং একটি অভ্যন্তরীণ অডিটের সিধান্ত হয়। তবে পরবর্তীতে তবে পরবর্তীতে সাধারণ সম্পাদক মিটিং ডাকলেও খোরশেদ আলম ধারাবাহিকভাবে বৈঠক বাতিল করতে থাকেন। চাপে পড়ে সাধারণ সম্পাদক আরেকটি বৈঠকের আয়োজন করলে ২০ সদস্যের মধ্যে ১১ জন উপস্থিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন, খোরশেদ আলমকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ বৈধ হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টকে দায়িত্ব দিয়ে পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।
এফবিসিসিআই ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ
সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে খোরশেদ আলম এফবিসিসিআইতে অভিযোগ দেন। উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে এফবিসিসিআই জানায়, প্রেসিডেন্ট অনুপস্থিত থাকলে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টই দায়িত্ব পালন করবেন। পরে খোরশেদ আলম বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রশাসক নিয়োগের আবেদন করেন। প্রায় ৮০০ সদস্যবিশিষ্ট এই বৃহৎ সংগঠনের পক্ষ থেকে তার অভিযোগে মাত্র ২৩ জনের স্বাক্ষর থাকলেও মন্ত্রণালয় একতরফাভাবে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। এতে বোর্ডের অন্যান্য সদস্যদের বক্তব্য একেবারেই উপেক্ষিত হয়। এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বোর্ড হাইকোর্টে রিট করলেও টানা তিনবার আদালত শুনানির অনীহা প্রকাশ করেন।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও আস্থা সংকট
খোরশেদ আলম ও তার সহযোগীদের অভিযোগ, সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বেনু সাহেব এবং সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন মৃধা দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম করে আসছেন। কিন্তু অভিযোগে সাক্ষরকারী ২৩ জন সদস্যের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে নিজেও বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। যেমন, ফাইজুল আলম ৬ বছর, শাহিদ আলম ৮ বছর, লিসা ৪ বছর, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহ সুলতান ১০ বছর এবং নাসিমা জাহান বিনতি ২ বছর ধরে বোর্ডে ছিলেন।
এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও অব্যবস্থাপনার কারণে সংগঠনের প্রতি অধিকাংশ সদস্যের আস্থা নষ্ট হয়েছে। এবারের নির্বাচনে ৮০০ সদস্যের মধ্যে মাত্র ১১৩ জন ভোটাধিকার নবায়ন করেছেন। ফলে এ নির্বাচন কার্যত বাতিল হয়ে যায়।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রভাব
সম্প্রতি চীন থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে এলেও তারা বাংলাদেশ-চায়না চেম্বারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। চীনা প্রতিনিধি দল খোরশেদ আলম ও তার সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীকে অযোগ্য বলে মনে করেছেন বলে জানা গেছে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ-চায়না চেম্বারের এ অস্থিরতা শুধু সংগঠনের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট নয়, বরং দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা ও বিনিয়োগ সম্পর্কের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ অবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারকদের কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কেকে/এজে